সুপার
ওভার
শিবাজী চ্যাটার্জী
"ভেরী গুড মর্নিং টু অল লিসেনারস...
ব্রাইট এন্ড সানি ওয়েদার অ্যাট ওয়াকা"...
মোবাইলে সেট করা প্রবাদপ্রতিম খেলোয়ার ও ধারাভাষ্যকার রিচি বেনোর রানিং
কমেন্ট্রীর অংশ রজতের অ্যার্লাম হিসাবে কাজ করে।
রোজ সকালে এই রিংটোনটাই রজতের শুধু মাইন্ডটাই ফ্রেশ করে না,
বাকি দিনটার জন্য চার্জড আপ করে দেয়। আজকে রোববারের সকাল। রজতের
প্র্যাকটিসও আজ অফ। কাল রাতে অ্যালার্মটা অফ করতে ভুলে গেছিল সে। সকাল ৬টায়
মোবাইলটা বেজে উঠতে ঘুমভরা চোখে রজত অ্যালার্মটা অফ করে এবং পাশবালিশটা টেনে আবার ঘুমের
দেশে যাবার তোড়জোড় করে।
মার ডাকে আবার ঘুমের রেশ কাটে রজতের।
রজতকে ডাকতে ডাকতে মা ভিতরে ঢোকেন।
এবার উঠে বসতেই হয় রজতকে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। ঢুলুঢুলু চোখে মার দিকে
তাকিয়ে বলে ওঠে - আজ আমার প্র্যাকটিস নেই মা।
এত তাড়াতাড়ি ডাকলে কেন?
মা- শোন ছেলের কথা! প্র্যাকটিস নেই বলে কি বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমাবি? নে নে ওঠ। মুখহাত ধুয়ে নে। তোর সাথে জরুরি
কথা আছে। আমি চা বসাচ্ছি।
মা শেষ কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে রজত বলে - এত সকালে কি জরুরি কথা
গো মা?
মা- তোর ছোটদাদু মানে আমার ছোটমামার চিঠি এসেছে গ্রাম থেকে। মনে হয় কোন সমস্যায় পড়েছেন। তুই ফ্রেস হয়ে আয়।
তারপর সব বলছি।
কথাকটি বলে বেরিয়ে যায় মা। রজত বসে ভাবতে থাকে। ছোটদাদু! তিনি তো সেই বিক্রমপুর বলে বসিরহাটের
এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন আজ অনেক বছর ধরে। এক সময় অবশ্য কোলকাতায় থাকতেন। শুধু
থাকতেনই না, বেশ দাপটের
সঙ্গে থাকতেন। বড় ব্যবসা ছিল তার। অল্প বয়সে ক্রিকেটও খেলেছেন চুটিয়ে। এরিয়ান
ক্লাবে খেলতেন। পরে খেলা ছাড়ার পরে সিএবিতে এক্সিকিউটিভ পদেও ছিলেন। তখন তো
কোলকাতায় রীতিমতো জমিয়ে ব্যবসা করছেন। রজত যখন বেশ ছোট তখন কয়েকবার রজতদের বাড়িতে
এসেছিলেন। তারপর ষাট বছর বয়সে সিএবি ব্যবসা সব ছেড়ে বিক্রমপুরে একটা জমি কিনে
বিশাল বড়ো একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানে গিয়ে থাকতে লাগলেন। এইসব অবশ্য প্রায় ১৫ বছর
আগের কথা। ওখানে চলে যাবার পর থেকে আর
কোলকাতার কারও সাথে সেরকম কোন সম্পর্ক রাখেননি। মার মুখে রজত শুনেছে যে ছোটদাদু বিয়ে
থাও করেননি, কেউ নেই ও সেই রকম তার। আজ এত বছর পরে রজত ও তার
মাকে হঠাৎ চিঠি লেখার কি কারন থাকতে পারে সে বুঝতে পারলো না। নাঃ, বিছানায় বসে বসে আকাশকুসুম না ভেবে উঠে পড়লো রজত। মুখচোখ ধুয়ে মার কাছে গিয়ে দেখতে হবে ব্যাপারটা
কি।
ফ্রেস হয়ে
ড্রয়িংরুমে এসে রজত দ্যাখে যে মা চা রেডি করে ডাইনিং টেবিলে বসে একটা চিঠির দিকে
চেয়ে আছে। মার মুখটা একটু চিন্তিত মনে
হচ্ছে। রজত এসে মার সামনে চেয়ারে বসলেও
মার মনোযোগে কোন ব্যাঘাত ঘটে না। রজত
নিঃশব্দে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নেয়। কাপটাতে একটা চুমুক দিয়ে মুখটা ব্যাজার করে
বলে উঠল- এঃ, এযে একদম ঠান্ডা
হয়ে গেছে মা।
এতক্ষণে চমক
ভাঙে মার। রজতের দিকে তাকিয়ে বলেন- ওমা!তুই কখন এসে বসলি? টের পেলাম নাতো।
- কি করে টের
পাবে? সমস্ত মন তো ওই চিঠিতে
পড়ে আছে। কি লিখেছেন ছোটদাদু?দাও দেখি চিঠিটা।
মার হাত থেকে
চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করে রজত।
"স্নেহের
রমলা,
আশা করি কুশলেই
আছো। আজ দীর্ঘদিন বাদে তোমাদের চিঠি লিখতে বসে অনেক কথাই মনে আসছে। সেইসব পুরোনো স্মৃতির কথা তিলে চিঠির দৈর্ঘ
বাড়াতে চাই না। আজ প্রায় ১৫ বছর তোমাদের
সবার থেকে আমি অনেক দূরে এই বিক্রমপুর গ্রামে বসবাস করছি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এই
নির্জন একাকীত্ব ভরা জীবন আমি বেছে নিয়েছিলাম কারন তুমি জানো যে কোলকাতায় আরাম বা
বৈভবের আমার কোন কমতি ছিল না। তাও একটা সময়ে এসে হঠাৎ সব কিছুর উপর দারুন বিতৃষ্ণা
এসেছিল। তাই শহুরে আরাম, বিলাস,
সন্মান,
প্রতিপত্তি সব ত্যাগ করে এই অজ পাড়া গাঁয়ে এসে বসবাস শুরু করি। একথা ভেবোনা
যে তোমাদের সবাইকে আমি ভুলে গেছি বা ভুলতে পেরেছি। বছর দশেক আগে তোমার
স্বামীবিয়োগের খবর আমি লোক মারফত পেয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে ফোন করে একটা স্বান্তনার
ভাষাও আমি শোনাতে পারিনি। আর এখন তো ফোন করার প্রশ্নও ওঠে না কারন...
কারনটা নয় পরেই
বলব। তুমি আমাকে হৃদয়হীন স্বার্থপর ভাবতেই পারো কিন্তু তাতে আমি কিছু মনে করবো না।
এত কথার
অবতারনা এই জন্যই করলাম কারন একটা বিশেষ কারনে তোমাদের সাহায্য আমার দরকার।
অবাক হবার কিছু
নেই। পুরোটা শুনলে সবই বুঝতে পারবে। আমি
যেখানে বসবাস করি সেটাকে বাড়ি না বলে অট্টালিকা বললেই ভালো হয়। বিক্রমপুরের একেবারে
সীমান্তে নদীর ধারে বাগান আর একটি খোলা মাঠের মতো জায়গা নিয়ে আমার বাড়ি। দেখভাল করার জন্য বেশ কিছু চাকরবাকর তো আছেই,
তার সাথে গাঁয়ের বেশ কিছু লোকজনও আমায় সময়ে অসময়ে সাহায্য করে থাকে। সাহায্য বলতে অবশ্য অর্থনৈতিক সাহায্য নয় কারন
ওই জিনিসটি আমার যা আছে তাতে আরও একশো বছর আমি বসে কাটাতে পারি। যাইহোক, গাঁয়ের বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত লোকও আমার বন্ধু ও প্রতিবেশী বিশেষ। তাদের সাথে সুখে দুঃখে বেশ নিরুপদ্রবেই দিনগুলো
কাটছিল।
কিন্তু বিগত
একমাস আগে এমন একটি ঘটনা ঘটে যার পর থেকে আমার এই নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা তোলপাড় শুরু
হয়ে গেছে। পুরো ঘটনা বিস্তৃত ভাবে চিঠিতে
লেখা সম্ভব নয় তবে আমার উপর সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে এসেছে যার ফলে আমার অপমৃত্যুরও
সম্ভাবনা আছে। ৭৫ বছর বয়সে এসে মৃত্যুর ভয়
করি না কিন্তু কিছু অশুভ শক্তির কাছে হেরে গিয়ে মৃত্যুবরন করাটাও শোভনীয় নয়। গাঁয়ে
আমার বন্ধুস্থানীয় জ্যোতিষী মাধববাবু আমার ভাগ্যগননা করে বলেছেন যে আমার নাতি
একমাত্র পারে আমায় এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আমার নিজের কোন বংশধর নেই। নাতি বলতে একমাত্র তোমার ছেলের কথাই মনে পড়ল।
হিসাব মতো তার এখন যুবক বয়স। তোমার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ যে তোমার মামার প্রান
রক্ষার্থে যদি তোমার ছেলেকে পাঠাতে পারো তো চির কৃতজ্ঞ থাকবো। কি করবে সত্বর
জানিও। চিঠিতেই উত্তর দিও। যদি ছেলেকে পাঠাও তাহলে তার হাতে এই চিঠিটি দিয়ে পাঠিও।
তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, তোমার ছেলের কোন ক্ষতি এখানে হবে না। সে নিশ্চয়তা আমি পেয়েছি। আর কি লিখিব।
আশীর্বাদ নিও।
ইতি
ছোটমামা
( রাঘব মিত্র)
চিঠিটা পড়া শেষ
করে রজত অবাক হয়ে মার দিকে তাকালো।
- এ কিরকম চিঠি
মা? কি বিপদ? কেন প্রান সংশয় এসব কিছুই তো উনি লেখেননি।
মা চিন্তিত
ভাবে বললেন-সেটাই তো পুরো বুঝতে পারছি না রে। ছোটমামাকে যতটুকু চিনি তাতে এই রকম
কোন রসিকতা করার লোক উনি নন। এতবছর বাদে এইরকম একটা চিঠি লেখার একটাই মানে হয়।
- কি মানে মা?
- ছোটমামা
সত্যি সত্যিই কোন ভয়ংকর বিপদে পড়েছেন। নাহলে ওনার মতো একজন দাপুটে আত্মসম্মানী
মানুষ দুহাত বাড়িয়ে আমাদের কাছে সাহায্য চাইতেন না।
- তাহলে আমার
তো অবিলম্বে ছোটদাদুর কাছে যাওয়া উচিত মা।
- সেটাতেই তো
মনস্থির করতে পারছি নারে। কি ধরনের বিপদ তার কোন আভাসও উনি দেননি। তুই তো আর পুলিশ
বা গোয়েন্দা নোস যে ওনাকে গিয়ে বাঁচাবি। তুই তো একজন ক্রিকেটার।
- হয়তো ওনার যা
সমস্যা সেটা একজন ক্রিকেটারই সমাধান করতে পারবে।
তুমি অতো ভেবো
না মা। আমায় অনুমতি দাও মা। হয়তো ওই বৃদ্ধ মানুষটা আমার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে
আছেন।
বিক্রমপুরের
পথে যেতে যেতে রজত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার
মনের মধ্যে কিছু ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। মা প্রথমে কিছুতেই যেতে দিতে চাইছিল না
বিক্রমপুরে। কিরকম সাহায্য করার জন্য ছোটদাদু রজতকে ডেকেছেন এবং কি অজানা বিপদ
সেখানে রজতের জন্য অপেক্ষা করে আছে সেটা চিন্তা করেই মার মন কিছুতেই মানছিল না।
রজতই বরং বেশ কিছুটা জেদাজেদি করে অনুমতি আদায় করেছে। এক অদম্য কৌতুহল হচ্ছিল তার ছোটদাদুর চিঠি পড়ার
পর থেকেই। ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লীগ শুরু
হতে এখনও মাসখানেক বাকি। তার ফ্রান্চাইজি দিল্লি টাইফুনের ফাইনাল প্র্যাকটিস শুরু
হতেও এখনও দুসপ্তাহ খানিক বাকি। রজত মোটামুটি সপ্তাহ খানেকের মতো জামা কাপড় গুছিয়ে
বেরিয়ে পড়েছে। মার মতো তারও মনে হচ্ছে যে
কি ধরনের বিপদে ছোটদাদু পড়েছেন যে এতটা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। রজতের জন্যই বা কি
ধরনের বিপদ ওঁত পেতে আছে সেখানে! সেটা কি কোন লৌকিক না অলৌকিক বিপদ? অবশ্য বিপদের ভয় রজত খুব একটা পায় না। জীবনে দুবার এমন দুটো ঘটনা তার সাথে ঘটেছে যে
এখন কোন কিছুতেই রজত ব্যাখ্যা খুঁজতে যায় না।
একবার মাথায়
বলের আঘাত লেগে কোমায় চলে গিয়ে সুস্থ ভাবে ফিরে আসা অথচ সেই মধ্যবর্তী সময়ে এক
অলৌকিক জগতে এক অলৌকিক ক্রিকেট ম্যাচে অংশগ্রহণ করা, পুরো ঘটনাটার কোন সঠিক ব্যাখ্যা রজত আজ অবধি খুঁজে পায়নি।
দ্বিতীয়বার কেনিয়ায় খেলতে গিয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিকের খপ্পরে পড়া। কোনটা লৌকিক কোনটা
অলৌকিক, কোনটা
স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব... রজত রায় আজও বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু এইটুকুই বুঝেছে যে
সাধারনের জানা বোঝার বাইরেও একটা জগত আছে যেখানে প্রচলিত নিয়মকানুন গুলো চলে না।
বিক্রমপুরে কি সেই অজানা জগতেরই কোন শক্তির সাথে রজতের মোলাকাত হতে যাচ্ছে! হালকা
হাসি ফুটে ওঠে রজতের ঠোঁটের কোনে। দেখাই যাক কি হয়...
বিক্রমপুরে
পৌঁছে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ছোটদাদুর বাড়ি খুঁজে পেতে রজতকে বিশেষ বেগ পেতে হলো না।
রাঘব মিত্রকে গাঁয়ের সকলেই ভালো রকমই চেনে। তার কারনটা রজত অচিরেই টের পেল যখন
দাদুর বাড়ির মেন গেট দিয়ে সে প্রবেশ করলো। গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমেই বাড়িটি চোখে পড়বে
না। গেট থেকে রাস্তা সোজা চলে গেছে কিছুটা, তারপর বাঁক নিয়েছে ডানদিকে। দুপাশে সার দিয়ে নারকেল, সুপারি, আম গাছের সারি। ডানদিকে বেঁকলে
চোখে পড়বে রাঘব মিত্রের বাড়ি। রজতের দেখে
মনে হলো এতো বাড়ি নয়, রীতিমতো প্রাসাদ বলা চলে। তিনতলা এই
বাড়ির গাড়িবারান্দায় এসে নিজের গাড়ি থেকে নামলো সে। বড়ো বড়ো খিলান দেওয়া একতলার
বারান্দার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাকে চিনতে রজতের ভুল হলো না। সাদা পান্জাবীর
সাথে সাদা ধুতি,
ব্যাকব্রাশ করা একমাথা সাদা চুলের সারি, চোখে রিমলেস
চশমা, উচ্চতা প্রায়
পাঁচ দশ বা এগারো। দাঁড়ানোর ঋজু ভঙ্গি বলে দেয় যে এক সময়ে যথেষ্ট দাপুটে লোক
ছিলেন।
রাঘব মিত্র
ওরফে রজতের ছোটদাদুও নাতিকে একবার দেখেই চিনে ফেলেছেন। রজত গাড়ি থেকে নামতেই এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।
- এই বুড়ো
মানুষটার ডাকে সাড়া দিয়ে তুমি সত্যি আসবে বা রমা তোমায় সত্যি পাঠাবে আমি ভাবতে
পারিনি রজত।
- কেন ছোটদাদু? আপনি কি আমাদের পর? আপনার
বিপদ মানে তো আমাদেরও বিপদ।
- ওসব কথা পরে
হবে। এখন চলো আগে ওপরে চলো। হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করো, বিশ্রাম করো। অনেকটা পথ ড্রাইভ করে এসেছ।
বিকেলে আমি আর তুমি আলোচনায় বসব।
বলেই রাঘববাবু
তার চাকরদের হাঁকডাক দিলেন। একজন এসে রজতের ব্যাগ নিয়ে ওপরে গেল। দাদুর সাথে রজতও
ওপরে এসে তার জন্য সাজিয়ে রাখা ঘরে এসে ঢুকলো।
দোতলায় তার
জন্য বরাদ্দ করা ঘরে ঢুকে রজত অবাক হয়ে গেল। গোটা ঘর অজস্র দামী জিনিসে ভর্তি। খাট, বিছানা, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি...
সর্বত্র দাম এবং রুচির চূড়ান্ত নমুনা দেখতে পেল সে। ঘরে ঢোকার পর সে রাঘব বাবুকে
বলল- দাদু, এ যে রাজকীয় ব্যবস্থা। কিন্তু আমার যে এত বিলাসে
থাকার অভ্যাস নেই।
- দাদুভাই, এইরকম ভাবতে নেই। এসবের উপর তোমার অধিকারও
কিছু কম নয়। যাই হোক, এখন এসব কথা থাক। তুমি স্নান খাওয়া করে
বিশ্রাম নাও। বিকালে আমরা অনেক গল্প করব। অনেক কথা জমে আছে তোমার জন্য।
এই বলে
রাঘববাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর রজতও সারাদিনের জার্নির ধকল কাটাতে স্নান সেরে
গরম গরম মাছ ভাত খেয়ে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিল। ঘড়িতে দেখল ১.৩০ বাজে। ভাবল ঘন্টা
দেড়েক ঘুমিয়ে নিলেই হবে। কিন্তু জানলা
দিয়ে আসা বাইরের তাজা ফুরফুরে হাওয়া রজতকে গভীর ঘুমে ঠেলে দিল।
দাদুর খাস চাকর
নিতাই এর ডাকে ঘুম ভাঙল রজতের। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে দেখল যে ৪টা বেজে গেছে। নিতাই তাকে বলল-
দাদাবাবু, হুজুর উপরে ছাদে আছেন। আপনাকেও সেখানে যেতে বলেছেন। আপনি যান, আমি আপনার চা
উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
চোখেমুখে জল
দিয়ে ফ্রেস হয়ে রজত ছাদে এল। দেখল যে ছাদের মাঝখানে একটা গোল টেবিল পাতা রয়েছে আর
সেই টেবিলকে ঘিরে তিনখানা চেয়ার। তার মধ্যে একটা চেয়ারে ছোটদাদু বসে আছেন আর একটা
চেয়ারে আর একজন ভদ্রলোক বসে। রজত কাছে
আসতে এই ভদ্রলোকটির সাথে তার পরিচয় হলো।
- এসো দাদুভাই
এসো। তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দি। ইনি হলেন আমার বন্ধু শ্রীমান মাধবচন্দ্র রক্ষিত।
এখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এখন অবশ্য অবসর গ্রহন করেছেন।
রজত নীচু হয়ে
মাধববাবুকে প্রনাম করতে যেতে মাধববাবু তাকে দুহাত দিয়ে তুলে জড়িয়ে ধরলেন। তিনজনে
চেয়ারে বসার পর আবার রাঘববাবু কথা বললেন।
- অবশ্য মাধবের
আরও একটা পরিচয় আছে। জোর্তিবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে গভীর পড়াশুনা এবং চর্চা আছে আর অকাল্ট তত্ত্ব নিয়েও
এনার জ্ঞানের পরিধি বিশাল।
এবার কথা বললেন
মাধববাবু।
- রাঘবদা একটু
বেশীই আমার ব্যাপারে বলে ফেলছেন। এই গন্ডগ্রামে থেকে খুব বেশী পড়াশুনার সুযোগ নেই।
তবে আমার এইসব ব্যাপারে কৌতুহল বরাবরই। তাই কর্মরত অবস্থায় ও তার পরেও মাঝে মাঝে
কোলকাতায় গিয়ে কিছু বইপত্তর কিনে এবং লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করে কিছু জ্ঞান হয়তো
অর্জন করেছি। একটা জিনিস কিন্তু বুঝেছি যে এই প্রকৃতিতে আমাদের জানার থেকে অজানার
পরিধি অনেক বেশী।
ইতিমধ্যে চা
এসে গেছিল। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে রাঘববাবু বললেন- বুঝলে রজত, আমি এই বিক্রমপুরে আসার পর মাধবের সাথেই
আমার প্রথম পরিচয় হয়। তারপর আস্তে আস্তে সেই পরিচয় কখন যে ঘনিষ্ঠতায় বদলে গেছে তা
বুঝতে পারিনি। অনেক ব্যাপারে ও আমায় হেল্প করেছে।
আজ আমার জীবনে যে দুর্বিপাক হাজির হয়েছে সেটার ব্যাপারে ওই আমায় সতর্ক
করেছিল। এখন সময় এসেছে তোমায় সব কিছু খুলে বলার।
রাঘববাবুর মুখ
থেকে রজত জানতে পারে যে আজ থেকে একমাস আগে একদিন সকালে মাধব রক্ষিত একটা চৌকো
বাক্স নিয়ে তার কাছে আসে। বাক্সটা মাধববাবুর ছেলে লন্ডন থেকে পাঠিয়েছে। সাথে একটা
চিঠিও ছিল আর তাতে লেখা ছিল যে মাধববাবুর প্রেততত্ত্ব তথা জ্যোতিষচর্চার গবেষণার
সুবিধার জন্য তার ছেলে এই বাক্সটি পাঠিয়েছেন।
বাক্সের ভিতরে একটা বই আছে, যদিও সম্পূর্ণ বই নয়। একটা অনেক
পুরোনো আমলের বইয়ের কিছু অংশ বা কিছু পৃষ্ঠা।
বইটি মাধববাবুর ছেলে লন্ডনের এক ভবঘুরের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে সংগ্রহ
করেছেন কিন্তু নিজে কিছু বুঝতে না পেরে মাধববাবুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এই পর্যন্ত
শুনে রজত বলে উঠল- আপনার ছেলে বইটা দেখে কিছু বুঝতে পারেনি কেন?
মাধববাবু- তার
কারন বইটির ভাষা কোন সাধারণ ভাষা ছিল না। প্রাচীন মিশরের হিব্রু ও গ্রিক ভাষার
সংমিশ্রণে বইটা লেখা ছিল। বইটা পাবার পর আমি ওই লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা
করি। বিভিন্ন ভাষার সংকেত ও প্রাচীন ভাষা নিয়ে আমার পড়াশোনাও ছিল ও কিছু বইপত্তরও
আছে। তারই সাহায্যে কিছু কিছু অংশের আমি
পাঠোদ্ধার করতে সফল হই। তাতে কিছু আশ্চর্য জিনিস আমি জানতে পারি। প্রেতশক্তির
আহ্বান, তাকে বশীকরনের মাধ্যমে
নিজের কাজে লাগানো, শয়তানের উপাসনা, বিভিন্ন
প্রকার কালো জাদু ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটু থামলেন
মাধববাবু। যুগপৎ একবার রাঘববাবু ও একবার রজতের দিকে দৃষ্টি দিলেন তিনি। আবার তার
বক্তব্য শুরু করলেন।
- তোমার কাছে
হয়তো এইসব কথা বা জিনিস অবাস্তব মনে হতে পারে কিন্তু ওই যে তখন বললাম যে প্রকৃতির
বেশীরভাগ রহস্যই আমরা এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। যাইহোক বইটির কিছু অংশের পাঠোদ্ধার
করার পরে আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। আমি কোলকাতায় আমার পুরোনো কিছু পরিচিত লোকজনের
কাছে খোঁজখবর নিলাম যারা এই পুরাতাত্ত্বিক আর প্যারানর্মাল কাজকর্মের সাথে যুক্ত।
তাদের থেকে কিছু কিছু জিনিস জেনে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে আমার কাছে যে বইটি আছে
সেটি পৃথিবীর সবথেকে ভয়ানক পাঁচটা বইয়ের মধ্যে একটা। বইটার নাম " বুক অফ
সোয়েগা"।
রজত একটু
আশ্চর্য হয়ে বলল- বুক অফ সোয়েগা! কই, নাম শুনিনি তো কখনও।
মাধববাবুর
ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল।
- না শোনাই
স্বাভাবিক। তোমার বা তোমার মতো সাধারণ মানুষেরা এই ধরনের বইয়ের কথা জানবে বরং
সেটাই অস্বাভাবিক। যতদূর জানা যায় যে ষোড়শ শতকে এই বইটি লেখা হয়েছিল যখন ইউরোপে রেনেসাঁসের
সময়। একের পর এক জাদুগরকে সেই সময় হত্যা করা হয়েছিল। তাদের জাদুবিদ্যার শ্রেষ্ট
নিদর্শন হিসাবে এই বইটি তখন লেখা হয়। সাধরন লোকের কাছে এটি অধরাই ছিল কারন এই বইটি
সংরক্ষিত ছিল লন্ডনের জাদুঘরের এক নিভৃত কক্ষে যেখানে সাধারনের কোন প্রবেশাধিকার
ছিল না।
এইবার কথা বলে
উঠলেন রাঘববাবু।
- এই তথ্য
আবিস্কার করার পরেই মাধব উত্তেজিত হয়ে এক সন্ধ্যায় বইটি নিয়ে ছুটে আসে আমার কাছে।
- ছুটে আসার
কারনও ছিল। বইটি বা বলা ভালো বইটির এই বিচ্ছিন্ন অংশ পৃষ্ঠাগুলির পরিচয় পাবার পর
আমি আমার ছেলেকে চিঠি লিখি। তার উত্তরে জানতে পারি যে লন্ডনের মিউজিয়ামের
গুপ্তকক্ষ থেকে বুক অফ সোয়েগা একদিনের জন্য উধাও হয়ে গেছিল। পরে আবার যথাস্থানে
সেটিকে পাওয়া যায়।
রজত- তার
মানে...
মাধব- তার মানে
কেউ বা কারা বইটি কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে মিউজিয়াম থেকে সরিয়েছিল আর তারপর কিছু
পৃষ্ঠা কপি করে আবার বইটি যথাস্থানে ফেরত দিয়ে দেয়। বইটির সেই বিশেষ কপি করা অংশই
আমার হাতে এসেছে।
রজত- এটা তো
পরিস্কার যে এর মধ্যে মিউজিয়ামের কোন লোক জড়িত ছিল। কিন্তু একটা ভবঘুরের কাছে বইটি
এলো কিভাবে?
মাধব- সে
প্রশ্ন আমার মনেও এসেছিল আর তাই আমার ছেলেকে আমি সেই ভবঘুরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা
করি। তাতে ছেলে বলে যে ওই ভবঘুরের দেহ টেমসের ধার থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। এটা শোনার পরেই আমি দৌড়ে আসি রাঘবদার কাছে।
এবার কথা বললেন
রাঘববাবু- মাধবের ধারনা যে এই বইটি অভিশপ্ত।
যে বা যারা এই বইটির সংস্পর্শে এসেছে তাদেরই জীবন সংশয় হয়েছে। তাই আমার কাছে আসে কি করা যায় সেই ব্যাপারে
পরামর্শ নিতে।
বিকেল
অন্তর্হিত হয়ে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে বিক্রমপুরে। ছাদের উপর বসে থাকা তিনটি
প্রানীর মুখে এইমুহুর্তে অন্ধকার আস্তে আস্তে থাবা বসাচ্ছে। চেয়ার থেকে উঠে ছাদের রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলেন
রাঘববাবু।
- দাদুভাই, মাধব যখন আমার কাছে বইটা নিয়ে আসে প্রথমে
আমি তার কথায় অত গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু পরে বইটা সম্বন্ধে সব কথা শোনার পরে আমার এক
অদ্ভুত কৌতুহল হয় আর সেই কৌতুহলই আমার জীবনে এক বিরাট দুঃশ্চিন্তা নিয়ে আসে।
রজত অবাক হয়
রাঘববাবুর কথায়।
- কি
দুঃশ্চিন্তার কথা বলছো দাদু? তোমার চিঠি পড়েও আমি তো সেই রকম কিছু বুঝিনি।
রাঘববাবু- সবই
বলবো তোমায়। কিন্তু নীচে চলো। অন্ধকার হয়ে গেছে।
আমার ঘরে বসে সব কথা হোক। চলো মাধব।
তিনজনেই উঠে
পড়ল চেয়ার থেকে। দোতলায় এসে রাঘববাবুর ঘরে
বসলো সবাই। রজত লক্ষ্য করলো যে সারা ঘরে
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
মাধববাবু বিছানার পাশে একটি চেয়ারে বসলেন। রজত রাঘববাবুর বিছানার একপাশে
বসলো আর রাঘববাবু নিজে গিয়ে দাঁড়ালেন জানলার সামনে। রজতদের দিকে পিছন ফিরে তিনি বলতে শুরু করলেন।
- ছোটবেলা
থেকেই ক্রিকেট খেলাটা বড়ো পছন্দ করতাম। বড়ো হবার সাথে সাথে সেই পছন্দ আরো বাড়তে
লাগলো। নিজের উদ্যমে এরিয়ান ক্লাবে খেলার সুযোগ পাই। হয়তো রাজ্যস্তরে বা
জাতীয়স্তরে খেলার সুযোগ পাইনি কিন্তু চুটিয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলেছি। পরে খেলা ছেড়ে
ব্যবসা করলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাটা অটুট রইলো।
একটু থামলেন
রাঘববাবু। জানলা থেকে সরে এসে বসলেন তার ইজিচেয়ারে। রজতের কৌতুহল উত্তরোত্তর
বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছোটদাদুর দিকে।
"এই
বিক্রমপুরে এসে সব কিছু ভুললেও ক্রিকেটকে ভুলতে পারলাম না। নিজের উদ্যোগে এখানে
একটা টুর্নামেন্ট শুরু করলাম স্থানীয় ক্লাবগুলিকে নিয়ে। বিক্রমপুরের খেলাপাগল
ছেলেছোকরাদের নিয়ে নিজেও একটা টিম বানালাম। নাম দিলাম ড্রিম ইলেভেন।
কিন্তু
দূর্ভাগ্য কি জানো দাদুভাই, আমারই শুরু করা প্রতিযোগিতা আমার টিম 'ড্রিম ইলেভেন' একবারও জিততে পারলো না। প্রত্যেক বছর মনের মধ্যে আশা তৈরি হয় যে এইবছর
হয়তো ট্রফিটা আমার ঘরে আসবে কিন্তু...
মাধবের আনা ‘বুক অফ সোয়েগা' আমার মনে নতুন আশার সঞ্চার করলো।
ওই বইতে
উল্লিখিত জাদুপদ্ধতি গুলো কি সত্যি? সত্যি কি শয়তান বা ইভিল শক্তিকে নিজের বশ করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা যায়?
কি রকম একটা জেদ চেপে বসলো যেন বুঝলে দাদুভাই। মাধবকে বললাম কথাটা। অবশ্য শুধু বললাম বলা ভুল, বলা উচিত তার উপর মানসিক চাপ
তৈরি করলাম।
উত্তেজিত হয়ে
উঠে দাঁড়ালেন মাধববাবু।
- আমি অনেকবার
মানা করেছিলাম রজত। অশুভ শক্তি নিয়ে খেলার চেষ্টা করতে নেই। তাতে হিতে বিপরীত হতে
পারে আর সেটাই হলো।
চেয়ারে হেলান
দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন রাঘববাবু।
- হ্যাঁ, শুনিনি আমি মাধবের বারন। আমার জেদের কাছে
শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করলো মাধব। আয়োজন করলাম সমস্ত কিছুর। আজকের রাতের মতোই ছিল
সেই রাত। তফাৎ ছিল শুধু যে সেদিন ছিল ভরা অমাবস্যার রাত। অবশ্য মাধবের মতে সেটাই
ছিল আদর্শ সময়। এই ঘরেই সম্পন্ন হয় সেই অশুভ বিধি। আমি, মাধব
ছাড়া আরও একজন ছিল সেইদিন রাতে। আমার ড্রিম ইলেভেন টিমের সেরা ব্যাটসম্যান অমিয়।
রজতের কৌতুহল
আর ধৈর্য্য আর যেন বাঁধ মানছিল না। কি অশুভ বিধি পালন করেছে তার ছোটদাদু! মনের
গভীরে আশঙ্কার একটা চোরা স্রোত যেন টের পেল রজত।
- কি হলো তারপর
দাদু? চুপ করে গেলে কেন?
বলো।
একটা চাপা
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাঘববাবুর বুক চিরে।
- অমিয় ছিল
আমার প্রচন্ড অনুগত। আমার টিমের ব্যাটিং এর স্তম্ভ ছিল সে। আমাদের বিধি সম্পন্ন
করতে তাকে আমাদের প্রয়োজন ছিল। এই ঘরেই পাতা হয়েছিল আসন। বিভিন্ন দেশীয় ও বিজাতীয়
জিনিসপত্রের সমাহারে সমস্ত বিধি নিখুঁতভাবে আমরা শেষ করি। এরপর শুধু বাকি ছিল শেষ
প্রনালী যেটা সম্পন্ন হলেই অমিয় আর শুধু সামান্য ব্যাটসম্যান থাকবে না। সে হয়ে
উঠবে অমিত শক্তিশালী, ক্ষিপ্র, দ্বিগুণ
বুদ্ধিমান এক ক্রিকেটার। বাইরে থেকে দেখলে কোন কিছুই বোঝা যাবে না কিন্তু মাঠে
খেলতে নামলে তাকে আর রোখা যাবে না। বিপক্ষের ক্ষমতা থাকবে না তাকে থামাবার। যেইরকম
উইকেট হোক, বিপক্ষে যত ভয়ংকর বোলারই থাক...অমিয়র সামনে তারা
ঝড়ের আগে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, বিপক্ষ
খেলোয়ারের মনের উপরও সে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে অর্থাৎ অপোনেন্টের বিচার
বুদ্ধিকে সে নিজের মতো চালনা করতে পারবে।
এবার একটু
নড়েচড়ে বসলো রজত। ঘটনাটা যতই শুনছে তত যেন তার মনের সব অন্ধকার পর্দাগুলো একটা
একটা করে সরে যাচ্ছে। ছোটদাদুর তাকে এখানে
ডেকে আনার একটা কারন যেন আস্তে আস্তে তার সামনে পরিস্কার হচ্ছে।
- শেষ
প্রনালীটা কি ছিল দাদু?
রজতের প্রশ্নে
মাথাটা নীচু করে নেন রাঘববাবু।
-
রক্তপান...মানুষের রক্তপান করাই ছিল সেই ভয়ংকর বিধি সম্পন্ন করার শেষ ধাপ।
দারুন চমকে ওঠে
রজত। ভয়ের একটা চোরাস্রোত যেন তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। বিছানা থেকে নেমে দাদুর
সামনে এসে দাঁড়াল সে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো রাঘব মিত্রের সামনে। একটু কাঁপা কাঁপা গলায় দাদুকে জিজ্ঞাসা করলো-
অমিয় কার রক্ত খেল দাদু?
- আমার...আমার
রক্ত পান করলো অমিয়। সে প্রথমে কিছুতেই এই জঘন্য বিধি মানতে রাজি হচ্ছিলো না। অনেক
বুঝিয়ে এবং টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে রাজি করাই। নিয়ম অনুযায়ী তিন বাটি রক্ত তাকে পান
করতে হতো। মাধব সিরিঞ্জের সাহায্যে আগেই আমার শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করে রেখেছিল।
অমিয় প্রথম বাটি রক্ত পান করার পর কিরকম যেন কেঁপে ওঠে। তারপর হড়হড় করে বমি করে দেয় এবং সংজ্ঞা হারিয়ে
লুটিয়ে পড়ে। আমি আর মাধব বেশ কিছুটা ঘাবড়ে
যাই। এই পৈশাচিক রীতি পালন করতে গিয়ে ছেলেটার কোন ক্ষতি হলো নাতো! বেশ কিছুক্ষণ
চোখেমুখে জল দেবার পর অমিয়র জ্ঞান ফেরে।
আশ্চর্যের
ব্যাপার কি জানো দাদুভাই যে জ্ঞান ফেরার পর অমিয় যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষে
রূপান্তরিত হয়েছে। নিষ্পলক চোখে নীরব
দৃষ্টি নিয়ে সে আমাদের দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিল বাকি রক্তটুকু পান করার জন্য। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে বাকি রক্তটুকু পান
করার সময় তার ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি। যেন
একবাটি জল সে পান করেছে এমনি ভাবে রক্তপান করার পরে অমিয় উঠে দাঁড়াল। আমি তাকে ডাকতেই সে ঘুরে তাকালো আমার
দিকে। তার ওই জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি আমি
কোনদিন ভুলতে পারব না। তাকিয়ে থাকতে
পারলাম না বেশীক্ষণ তার দিকে। ভয়ে হোক
কিংবা আতঙ্কে হোক, সরিয়ে নিলাম নিজের দৃষ্টি। হঠাৎ মাধবের ডাকে যেন সম্বিত ফিরল। তাকিয়ে দেখি
যে অমিয় নেই, ঘর
ফাঁকা। মাধব জানাল যে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে অমিয় আর তাকে আটকানোর ক্ষমতা
মাধবের ছিল না।
টানা এতগুলো কথা
বলে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন রাঘববাবু।
ইজিচেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন তিনি। রজত তন্ময় হয়ে
শুনছিল এতক্ষণ রাঘববাবুর কথা। তিনি থামতেই
সে বলে উঠল- কি হলো দাদু? থামলে
কেন? কি হলো অমিয়র? কোথায় গেল সে?
উত্তর দিলেন
মাধববাবু।
- অমিয় ওইরকম
ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় রাঘবদা ও আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়ি। বিধবা মায়ের একমাত্র
ছেলে সে। কোথায় গেল সে সেই গভীর রাতে?
এই বাড়ির কিছু
লোকজনকে নিয়ে আমরা অমিয়কে অনেক খুঁজলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না। অবশ্য পাবই বা কি
করে! পরেরদিন সকালে অমিয়র সংজ্ঞাহীন দেহ নদীর ধারে শশ্মানের পাশ
থেকে উদ্ধার হয়। জামা কাপড় ছেঁড়া ও প্রায় উলঙ্গ এবং প্রচন্ড জ্বরে বিকারগ্রস্ত
অমিয়কে শশ্মানের পারে বসবাসকারী কিছু লোক বাড়ি পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে আমি ও রাঘবদা
দুজনেই ওর বাড়ি যাই। জ্ঞান ফিরলেও প্রবল জ্বরে সে তখন আক্রান্ত। রাঘবদাই ডাক্তার
আনান। কিন্তু দুদিন অতিবাহিত হলেও ঔষধ খেয়েও তার জ্বর কমে না। দুশ্চিন্তায় রাঘবদা
খুব ভেঙে পড়েন। আমাকে এও বলেন যে আমাদের পদ্ধতি কোন কাজ করেনি উল্টে ছেলেটাকে এই
বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোলকাতায় নিয়ে
গিয়ে ভাল হাসপাতালে চিকিৎসার কথাও উনি বলেন। কিন্তু আমি রাঘবদাকে আর একটা দিন ধৈর্য্য
ধরতে বলি। আমার পদ্ধতিতে কোন ভুল ছিল না। বুক অফ সোয়েগার প্রত্যেকটা স্টেপ আমি
নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেছিলাম। সেইদিন ছিল শনিবার। আমার মন বলছিল যে ওইদিন কিছু একটা
হবে কারন শয়তানি শক্তির বিকাশ মঙ্গল আর শনিবারেই হয়। তাই রাঘবদাকে আমি ওইদিনটা
অপেক্ষা করতে বলি।
আবার কথা বলেন
রাঘববাবু।
- ওইদিনটা কি
করে ভুলব মাধব! জানো দাদুভাই, মাধবের মুখে আশ্বাসবানী শোনার
পরেও মনটা ছটফট করছিল। সারাটা
দিন ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করেছি আর বারেবারে আমার লোক দিয়ে অমিয়র শরীরের
সংবাদ নিয়েছি। বিকেলবেলায় আমার লোক এসে
জানালো যে অমিয়র জ্বর নাকি অনেকটা কমেছে।
সে উঠেও বসেছে আর খাবারও খেয়েছে।
অস্থির মনটা শান্ত হবার পর যখন আমি ও মাধব সেদিন সন্ধ্যায় এই ঘরে বসে একটু
চা পান করছি, ঠিক তখনই এলো
সে।
- কে? কে এলো ছোটদাদু?
- অমিয়...ঝড়ের
মতো ঢুকলো সে। চোখ লাল, মুখ
দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার
দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল "দিন"।
আমি তো
হতভম্বের মতো বসে একবার অমিয়র দিকে আর একবার মাধবের দিকে তাকালাম। দেখলাম যে মাধব
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অমিয়র দিকে তাকিয়ে আছে।
এদিকে অমিয় হয়ে উঠেছে অধৈর্য্য।
আবার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল "কই দিন"।
এই সময় মাধব
হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল তাকে..."না। যা তুমি চাইছো সেটা তোমায় দেওয়া যাবে না। তুমি
বাড়ি যাও অমিয়।"
কিন্তু অমিয়র
তখন অন্য মূর্তি। ভীষন মুখ বিকৃতি করে সে বলে উঠল - "কোথায় যাব? বাড়ি...হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। রেখেছেন আমার বাড়ি
যাবার রাস্তা? কোথাও যাবার রাস্তা রেখেছেন আপনারা?"
চিৎকার করে উঠল
সে। এগোতে গেল আমার দিকে আর ঠিক তখনই মাধব তার পকেট থেকে বের করলো একটি ছোট্ট
ত্রিশূল। আগুয়ান অমিয়র সামনে বাড়িয়ে ধরলো সেটা। সঙ্গে সঙ্গে যেন ম্যাজিকের মতো কাজ
হলো। একটা চাপা আর্তনাদ করে চোখমুখ কুঁচকে পিছনে ছিটকে গেল অমিয়। কঠোর স্বরে মাধব
তাকে চলে যেতে বলল। চলে গেল অমিয় আর দ্বিরুক্তি না করে কিন্তু যাবার আগে আমাদের
দুজনের দিকে যে ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে গেল সেটার কথা ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়।
একটানা এতক্ষণ
কথা বলে যেন ভীষন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন রাঘববাবু। রজত বুঝতে পারে যে ছোটদাদু বেশ
উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাধববাবুর দিয়ে তাকায়। মাধববাবু এগিয়ে
আসেন রাঘব মিত্রের দিকে।
- আপনি একটু
শান্ত হোন রাঘবদা। রজতকে বাকি ঘটনাটা আমি বলছি।
মাধববাবুর মুখ
থেকে বাকি ঘটনাটা শোনে রজত।
"তখনকার
মতো অমিয় বেরিয়ে গেলেও তার মূর্তি দেখে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। অমিয়র ঘন ঘন জিভ
দিয়ে ঠোঁট চাটা...অপলক চোখের চাহনি...বারবার আঙুল মটকানো...এই ধরনের চিন্হ দেখে
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে আমার করা পৈশাচিক প্রক্রিয়া সফল হয়েছে। মানুষ থেকে দানুষে রূপান্তরিত হয়েছে অমিয়। দানুষ অর্থাৎ মানুষ রূপী দানব যার ক্ষমতা অসীম।
রাঘবদাকে বললামও সব কথা। দানুষ হওয়ার
জন্যই ওইদিন রাতে অমিয় তার খাবার চাইতে এসেছিল।
খাবার অর্থাৎ তাজা রক্ত। চমকে উঠো
না রজত। মঙ্গল,
বৃহস্পতি আর শনি...এই তিনটি দিনে দানুষের প্রয়োজন হয় তাজা মানবরক্তের যা
তাদের শক্তিকে সুরক্ষিত রাখে। তবে হ্যাঁ, ওই প্রক্রিয়া
সম্পন্ন করার সময় আমি একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অমিয়র গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছিলাম
আর সেটা হলো যে ক্রিকেট খেলার সময় ব্যাট বা বল হাতে থাকলে তবেই সে তার শক্তির
বহিঃপ্রকাশ করতে পারবে,
অন্য সময় নয়। রাঘববাবুর উদ্দেশ্য
সিদ্ধ হয়েছে... এবার অমিয়র দানবীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওনার টিম ড্রিম ইলেভেন ওনার
নামাঙ্কিত ট্রফি জিতবে... এটা ভেবে যেমন আমরা খুশী হয়েছিলাম ঠিক একই সময়ে
দূর্ভাবনা হলো যে রক্তপিপাসু অমিয় কোথায় গেল তার পিপাসা মেটাতে!
উত্তর
পেয়েগেলাম পরেরদিন সকালে যখন জানলাম যে অমিয়র মা গতরাতে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে ভীষণ
চোট পেয়েছে। অমিয়কে ডেকে পাঠাতে সে এল।
দেখলাম গত রাতের পুরো উল্টো ছবি। ভীষন রকম
শান্ত সে আর ততোধিক শান্ত ও অনুভূতিহীন তার চোখের চাহনি। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে সে
নির্বিকারভাবে জানালো যে তৃষ্ণায় তার গলা এতটাই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল যে সে আর
সহ্য করতে পারেনি। বাড়ি গিয়ে আচমকা মওকা
বুঝে মার মাথায় পিছন থেকে লাঠির বাড়ি মারে। মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। মাথা ফেটে গলগল
করে রক্ত বেরোতে থাকে আর সেই রক্ত সেই মুহুর্তে অমিয়র তৃষ্ণা মেটায়। তার এই জঘন্য
কাজের বিবরন শুনে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই।
"গলাটা
পুরো শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। মার মাথা থেকে বেরোনো রক্ত মেঝে থেকে কাঁচিয়ে যখন পান
করলাম...আঃ...এক লহমায় বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন এখন তেষ্টা পেলে জল
খেতে একদম ইচ্ছে করে না। বেড়ে টেস্ট কিন্তু জিনিসটার।"
ঠিক এই ভাষাতেই
শান্তভাবে নিজের কীর্তির বর্ননা করলো অমিয়। সেই সাথে আমাদের হুমকিও দিল যে তার
তৃষ্ণা মেটানোর নিয়মিত বন্দোবস্ত যদি আমরা না করি তাহলে এরপর গাঁয়ের অনেকেরই
অনেকরকম দূর্ঘটনা ঘটতে থাকবে। "
কথা শেষ করে
মাধববাবু রজতের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন- এখন তুমিই পারো আমাদের এই
বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে।
মাধববাবুর এই
শেষ কথায় হঠাৎ যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল রজতের।
-আমি? আমি কিভাবে আপনাদের বাঁচাতে পারি? আমি কি তান্ত্রিক না জ্যোতিষী!আমি একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়।
এগিয়ে এল রজত
রাঘববাবুর দিকে।
- ছোটদাদু, অনেকটা শ্রদ্ধা আর সমীহ নিয়ে আমি
বিক্রমপুরে এসেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনা শোনার পরে তোমার সম্পর্কে আমার আগের সমস্ত
ধারনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। নিজেদের লোভ আর এক্সপেরিমেন্ট চরিতার্থ করতে গিয়ে তোমরা
একজন খেলোয়ারকে নরপিশাচ বানিয়ে দিয়েছ। তুমি তো নিজে একসময় খেলোয়াড় ছিলে। নূন্যতম
স্পোর্টসম্যান স্পিরিট থাকলে তুমি এইধরনের কাজ করতে পারতে না। এখন আমায় অনুরোধ
করছো যে তোমাদের বাঁচাতে। আমি সত্যিই জানি
না কিভাবে তোমাদের বাঁচানো যায় কিন্তু সেটা যদি জানতামও তাহলেও তোমাদের হেল্প আমি
করতাম না।
নিজের কথা শেষ
করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো রজত। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে তাকালো সে।
- মিঃ রাঘব
মিত্র, আমি কাল সকালেই কোলকাতা ফিরে যেতে চাই...গুড
নাইট।
" যেতে
চাও তো নিশ্চয় চলে যেও দাদুভাই। কিন্তু
চলে যাবার আগে এই বুড়ো মানুষটার যন্ত্রণার শেষ কথাগুলো শুনে যাও। শোনার পরেও যদি
মনে হয় যে তুমি কালকেই চলে যাবে তো রাঘব মিত্র তোমাকে আটকাবে না।
সেদিন অমিয় চলে
যাবার পরে আমি ও মাধব খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এক তো অমিয়র পৈশাচিক
কার্যকলাপ কিভাবে আটকানো যায় তার চিন্তা অন্যদিকে টুর্নামেন্ট শুরু হতেও আর বেশী
দেরি নেই।
কিছুদিনের
মধ্যেই এদিক ওদিক থেকে বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা বা দূর্ঘটনার খবর আসতে লাগল। আমারই
টিমের অন্য একজন খেলোয়ার রশিদ সন্ধ্যার মুখে টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে বটতলায়
আক্রান্ত হয়। কে যেন তার মাথায় পিছন থেকে শক্ত কোন কিছু দিয়ে বাড়ি মারে। অজ্ঞান
অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর তার হুঁশ আসে।
বেশ কিছুটা রক্তক্ষরণ ডাক্তারের মতে হয়েছিল কিন্তু রশিদ যেখানে পড়েছিল তার
আশেপাশে রক্ত ছিল না। এর পরে একদিন আমার বাজার সরকার মথুরামোহন নিজের বাড়ির কলতলায়
সন্ধ্যা বেলায় একইভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। স্কুলমাস্টার রবির ভাগ্যেও একই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি যখন হয় তখন আমার ও মাধবের মনে কোন সন্দেহই থাকে না যে এই সব ঘটনার
সাথে একজনই জড়িত আর সে হলো অমিয়।
অমিয় কিন্তু ইতিমধ্যে প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছিল। একদিন প্র্যাকটিস শেষে
আমরা তাকে ডেকে পাঠাই এবং এইসব ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। অম্লানবদনে
সে স্বীকার করে নেয় তার দোষ। আমরা তাকে
কড়াভাবে সংযত হতে বললে সে নিজের স্বমূর্তি প্রকাশ করে এবং আমাদের শাসায় যে এরপরের
শিকার আমরাই হবো। এও বলে যে অল্প অল্প
রক্ত খেয়ে তার মন মানছে না। পূর্ণ দানুষ হতে গেলে তার প্রয়োজন একজন মানুষের সব
রক্ত। আমরা কাউকে জানালে সে আমাদেরি তার
শিকার বানাবে। বলাবাহুল্য যে তার এই হুমকিতে আমি বিচলিত হই না এবং তাকে আমার টিমে
না খেলানোর সিদ্ধান্ত নিই। অমিয়কে সেকথা জানাতে সে প্রচন্ড রাগে অস্থির হয়ে পড়ে
এবং আমাকে জানায় যে এই ট্রফি সে আমাকে পেতে দেবে না। এরপরে সে আমাদেরই পাশের গাঁ
নসিবপুরের বুলেটস ইলেভেনে যোগ দেয় এবং আমায় এসে জানায় যে ফাইনালের দিন ট্রফি জিতে
সে আমার রক্ত পান করে পূর্ণ দানব হবে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। আমি নিজের
মৃত্যুর ভয় করি না দাদুভাই কিন্তু আমি নিজের কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
অন্যায়ভাবে অমিয়কে অলৌকিক শক্তির সাহায্যে ট্রফি জিততে আমি দেখতে পারবো না...পারবো
না।
এই শেষ কথাটি বলে ছেলেমানুষের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাঘববাবু। স্তম্ভিত রজত
আস্তে আস্তে ফিরে আসে তার দাদুর কাছে।
দাদুকে দুইহাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরে সে।
- সরি দাদু...সরি। আমি কোথাও যাচ্ছি না। দানব বনাম মানবের এই যুদ্ধে আমি আছি
তোমাদের সাথে। বলো,
বলো আমায় কি করতে হবে?
গলাটা একটু খাঁকরিয়ে নিয়ে মাধববাবু বললেন- ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ
নয় রজত। অমিয় এমনি এমনি বুলেটস ইলেভেনে যোগ দেয়নি। বুলেটস ইলেভেনের কর্নধার
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য একাধারে যোগী এবং তান্ত্রিক। লোকদেখানো একটা ব্যবসা তার আছে
বটে কিন্তু আমি জানি টাকার বিনিময়ে নানারকম পৈশাচিক তন্ত্রসাধনা করে লোকের ক্ষতি
সাধন করাই তার আসল কাজ। আমি নিশ্চিত যে অমিয় তাকে সব বলেছে আর সেও অমিয়কে আরও
শক্তিশালী দানুষ করে তুলতে কোন কসুর রাখে নি।
রজত- কিন্তু আপনি এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?
মাধব- ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কিন্তু শুরু হয়ে গেছে রজত আর তাতে বুলেটস ইলেভেনের অমিয়
মারকাটারি কান্ডকারখানা ঘটাচ্ছে। প্রথম
ম্যাচে অপোনেন্টের করা ১৮০ রান সে মাত্র ৯ ওভারে তুলে দেয়। একাই করে ১৬০ ওপেন করতে
নেমে। এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে অমিয়রা করে ২০ ওভারে ৪৪০ রান। অমিয়
একাই ৩০০ রান করে যাতে ৩০টা ছয় ছিল। তৃতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ ওয়াকওভার দিয়ে দেয়।
অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে তাতে আমাদের সাথেই তার ফাইনালে দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে।
রজত অবাক হয়ে
গেল ম্যাচগুলির রেজাল্ট জেনে। মাধববাবুর কথায় সে আরও বুঝতে পারলো যে খেলার সময়
অমিয় তার দানবীয় ক্ষমতাবলে বিপক্ষ খেলোয়ারের মনের উপরও প্রভুত্ব স্থাপন করছে। ভারি অদ্ভুত লাগলো তার। এইরকম অলৌকিক শক্তিতে
শক্তিমান একজনকে তার মতে একজন সাধারণ ক্রিকেটার কি করে থামাবে!
রজতকে চুপচাপ
থাকতে দেখে এবার রাঘববাবু বললেন- বুঝতে পারছো দাদুভাই, কি
ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে আমরা পড়েছি। আমার টিমও ভালো খেলছে, মনে হচ্ছে ফাইনালে উঠবে। তোমাকে আমার টিমে খেলতে হবে কিন্তু দাদুভাই
শুধু খেললেই তো আর তুমি অমিয়কে আটকাতে বা হারাতে পারবে না।
মাধব- অমিয় এখন
দানবীয় শক্তিতে শক্তিমান। কিন্তু ওর
প্রধান শক্তি খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ। যদি
ওকে ক্রিকেট ম্যাচে হারানো যায় তবেই ওর মধ্যে একটা দারুন হতাশা গ্রাস করবে। হারার
সাথে সাথে ওর অলৌকিক শক্তি অন্তর্হিত হবে।
রজত- কিন্তু
ওকে আমি কি করে হারাবো দাদু? আমি তো আমার সাধারণ শক্তিতে খেলে ওর সামনে দাঁড়াতেই পারবো
না।
গলাটা সামান্য
খাঁকড়িয়ে নিয়ে মাধববাবু বললেন- রজত, অমিয়র মোকাবিলা করতে হলে অমিয়র মতন হয়ে লড়তে হবে।
রজত- মানে? অমিয়র মতন হয়ে লড়তে হবে মানে? পরিষ্কার করে বলুন।
রাঘববাবু-
দাদুভাই, দানুষ অমিয়র সৃষ্টি করার পর যখন কোন দিশা আমি
দেখতে পাচ্ছি না তখন মাধব আমায় পথ বাতলায়। ও আগেও আমার কুষ্ঠি বিচার করেছিল। এবারও ওই জানায় যে আমায় এই বিপদ থেকে বাঁচাতে
পারে আমার দৌহিত্র যার দেহে আমার রক্ত বইছে।
তুমি ছাড়া আমার দৌহিত্র বা নাতি বলতে আর কেউ নেই। কিন্তু...
রজত- কি কিন্তু
দাদু?
রাঘববাবু-
কিন্তু আমায় বাঁচাতে গেলে তোমাকেও তো ওই পৈশাচিক পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে দাদুভাই।
চমকে উঠল রজত।
এই কথা তো সে ভাবনাতেও আনেনি। এই অসম্ভব ভয়ংকর পদ্ধতি সে কিছুতেই গ্রহন করতে পারবে
না।
- কিন্তু রজত তুমি যদি দানুষে রূপান্তরিত না হও তাহলে অমিয়কে আটকাতেও পারবে না
আর তোমার দাদুকে বাঁচাতেও পারবে না। ফাইনাল ম্যাচ যদি অমিয় জিতে যায় তাহলে শুধু
তোমার দাদু নয়, পুরো
বিক্রমপুরের উপর সে প্রলয় নিয়ে আসবে কারন তার পিছনে আছে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের
শয়তানি মস্তিষ্ক।
- আমায় আজকের রাতটা ভাবতে সময় দিন। দাদু, এইকথা ভেবোনা যে আমি মৃত্যুভয় পাচ্ছি।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি
একজন ক্রিকেটার। মাঠ আমার কাছে পবিত্র মন্দির।
সেই মাঠে নেমে অলৌকিক শক্তির সাহায্য নেব...এটা সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময়
লাগবে।
এগিয়ে এলেন রাঘববাবু রজতের দিকে। তার
দুইকাঁধে হাত রেখে বললেন- বেশ দাদুভাই...ভাবো আজকের রাতটা। আশা করি তোমার সকালের
সিদ্ধান্ত বিক্রমপুরকে এক অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে।
রাতের খাওয়া সেরে নিজের ঘরে এসে ঢুকল রজত। মনটাকে কিছুতেই স্থির করতে পারছে না
সে। বিকেল থেকে রাত অবধি দাদু ও মাধববাবুর কাছে যা যা শুনেছে বাস্তব জগতের সাথে
কিছুতেই সেটা মেলাতে পারছে না রজত। আবার এই পাড়াগাঁ বিক্রমপুরে রাত ৯টাতেই গভীর
রাত বোধ হওয়াতে রজতেরও মনে হচ্ছে যে যা যা সে শুনেছে সবই হয়তো সম্ভব। দুজন বয়স্ক লোক তার সাথে মজা করতে তো তাকে
কোলকাতা থেকে ডেকে আনেনি। নাঃ আর ভাবতে ভালো লাগে না তার। ছোটদাদুকে বাঁচানোর
জন্যই সে এসেছে এবং সেটাই সে করবে। দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে। জানলা অবশ্য
খোলাই রাখলো। শোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই
চোখটা আস্তে আস্তে বুজে এল রজতের।
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রজতের। কিরকম যেন
একটা চাপা অস্বস্তি টের পেল সে। শরীরের উপর যেন একটা গুরুভার অনুভব করলো। নিঃশ্বাস
নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। চোখটা খুলে তাকালো
সে। সামনে নিকষ কালো অন্ধকার আর তার মধ্যে দুটো
জ্বলজ্বলে আলোর বিন্দু ছাড়া কিছুই নজরে এলো না। হঠাৎ টের পেল যে সামনের ওই
অন্ধকারের স্তুপ আর কিছুই নয়, একটা শরীর যেটা তার শরীরের উপর চেপে বসেছে। জ্বলজ্বলে আলোর বিন্দু ওই
শরীরের দুটো চোখ। রজত তার হাত পা নাড়তে গেল কিন্তু ওই শরীর রজতের উপর এমনভাবে চেপে
বসেছে যে সে বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করতে পারছে না। এবার ওই জ্বলজ্বলে চোখদুটো আস্তে
আস্তে রজতের দিকে নেমে আসতে লাগলো। চিৎকার করতে গেল সে কিন্তু গলা দিয়ে ঘড়ঘড়ে
আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোলো না। নিজের মুখের উপর ওই শরীরের নিঃশ্বাসের অনুভূতি টের পেল
সে আর সাথে পেল পচা মানব শরীরের দূর্গন্ধ। গা পাক দিয়ে বমি পেয়ে গেল তার। ভয়ে
দিশাহারা হয়ে চোখ বন্ধ করে নিল সে আর সেই মুহুর্তেই দড়াম করে দরজা খোলার
আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল ঘরের বাতি।
বিস্ময়ের সাথে রজত দেখল যে তার উপর চেপে বসে থাকা শরীরটা একলাফে সরে গেল। সেও
লাফিয়ে উঠল বিছানার উপর। দেখল যে দরজার সামনে হাতে সেই ছোট্ট ত্রিশূলটা সামনে
বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মাধব রক্ষিত। পাশে দাঁড়িয়ে ছোটদাদু। মাধব রক্ষিতের দৃষ্টি
অনুসরণ করে রজত তার ডানদিকে তাকিয়ে দেখল যে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দারুন আক্রোশে ফোঁস
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে একটা লোক। অবশ্য সাধারণ লোক বলা তাকে ভুল। গায়ের চামড়া
অতীব ফ্যাকাশে, তার সাথে সমস্ত ত্বক ফেটে সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। মুখ দিয়ে লালা ঝড়ছে আর দুটো চোখ যেন জ্বলন্ত
আগুন যেটাকে রজত অন্ধকারে জ্বলজ্বলে আলো বলে ভেবেছিল। দারুন আতঙ্কে রজত চিৎকার করে
বলে - কে? কে ও?
- অ...অমিয়।
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেন রাঘববাবু।
এই অমিয়! রজত অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু এতো কোন জান্তব চেহারা নয়। এতো সাক্ষাৎ
নরপিশাচ।
একটা চাপা গর্জনের সাথে রজতের দিকে এগোতে যায় অমিয় আর সেই সময় গর্জে ওঠে মাধব
রক্ষিতের গলা।
- সাবধান অমিয়...আর এক পা এগোবার চেষ্টা করবে না।
নিজের হাতের ত্রিশূলটা সামনে নিয়ে এগিয়ে আসেন তিনি। একটা গোঙানির সাথে চোখমুখ
কুঁচকে দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে যায় অমিয়।
আবার গর্জে ওঠে মাধববাবুর গলা- তোমাদের শয়তানি আমি বুঝি না ভেবেছো। যাও,
তোমার মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যকে গিয়ে বলে দাও যে তার শয়তানির জবাব আমাদের হাতে
এসে গেছে। একজন দানুষ থেকে ও তোমাকে
নরপিশাচ বানিয়েছে তো। এবার দেখবে যে ওর সাথে সাথে তোমার খেলাও কিভাবে শেষ করি। যাও
এখনি এখান থেকে।
রজতের দিকে একটা দারুন ঘৃনার দৃষ্টি দিয়ে অমিয় ছুটে গেল জানলার দিকে যার শিক
আগেই বাঁকিয়ে সে এই ঘরে প্রবেশ করেছিল। ওই জানলা দিয়েই সে নিমেষে বেরিয়ে গেল। রজত, মাধববাবু ও রাঘববাবু তিনজনেই জানলার কাছে
এসে দেখলেন যে মাকড়সার মতো দেয়াল বেয়ে অনায়াসে অমিয় নেমে যাচ্ছে দোতলা থেকে নীচের
দিকে। নীচে নেমে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল
বাগানের ভিতর দিয়ে। হতবাক রজত এসে ধপাস
করে বসে পড়লো খাটের উপর।
দ্রুত তার কাছে এসে রাঘববাবু বললেন- দাদুভাই তোমার কিছু হয়নি তো?
- না রাঘবদা, রজতের কোন ক্ষতি
অমিয় করতে পারেনি যদিও ক্ষতি করবার ইচ্ছে নিয়েই সে এসেছিল।
এখনও যেন ঘটনাটার ঘোর রজত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অস্ফুটস্বরে সে বলল- কি ক্ষতি করতে এসেছিল ও?
কঠিন স্বরে উত্তর দিলেন মাধববাবু।
- ও এসেছিল তোমার রক্ত পান করতে। এসেছিল বলা ভুল, বলা উচিত ওকে পাঠানো হয়েছিল। তুমি যে এই গ্রামে এসে এই বাড়িতে উঠেছো সেটা ওর
লোক মারফত জানতে পেরেছে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য এবং এটা আন্দাজ করে নিতে তার অসুবিধা
হয়নি যে অমিয়র বা অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতেই তুমি এসেছো। আজ তোমার রক্ত পান করে
যদি অমিয় তোমার দেহে তার বিষ ঢুকিয়ে দিতে পারতো তাহলে আমরা আর তোমাকে অমিয়র
বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারতাম না। তাই নিজের মন্ত্রশক্তির সাহায্যে ও অমিয়কে
পাঠিয়েছিল এই ঘৃন্য চক্রান্তকে বাস্তব রূপ দিতে।
কিন্তু ঠিক সময়ে আমরা টের পাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হলো না।
শিউরে উঠল রজত মাধববাবুর বর্ননা শুনে। এরআগে রজতের সাথে অতিপ্রাকৃত ঘটনার
পরিচয় ঘটলেও এইরকম রক্তলোলুপ নরপিশাচের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। তার মুখের দিকে
তাকিয়ে রাঘববাবু বলে উঠলপন- মাধব, এখন কি উপায় স্থির করা যায় সেটা বলো।
মাধব- আর দেরি করা ঠিক হবে না রাঘবদা। অমিয়র বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি
আমাদের এখনই নিতে হবে। বেশী দেরি করলে যদি কোন অঘটন ঘটে যায় তাহলে...
মাধব রক্ষিতকে
কথাটা শেষ করতে দেয় না রজত। উঠে দাঁড়িয়ে মাধববাবুর সামনে এসে বলে- আমি প্রস্তুত।
যা উপাচার করার আছে সেটা সম্পন্ন করুন। বানিয়ে দিন আমাকে অমিয়র বিরুদ্ধে লড়াই
করবার উপযুক্ত। লড়াই তো হবে ক্রিকেট
মাঠে। দেখি শুভ আর অশুভ শক্তির লড়াইয়ে কে
জেতে!
এগিয়ে এসে
রজতের মাথায় হাত রাখেন রাঘববাবু।
- তোমাকেই যে
জিততে হবে দাদুভাই। তুমি না জিতলে শুধু যে আমাদের পরাজয় হবে তা নয়, ক্রিকেটও যে হেরে যাবে।
মাধববাবু
বললেন- রজত, তুমি এখন শুয়ে
পড়ো। আশাকরি আর কোন উপদ্রব হবে না। আগামীকাল সকাল থেকে আমাদের অনেকগুলো কাজ
আছে। আমায় বুক অফ সোয়াগায় বর্নিত
উপাদানসমূহ যোগাড় করতে হবে। রাঘবদা, আপনি রজতের খেয়াল
রাখবেন। কাল কিন্তু শনিবার। সন্ধ্যা নামলে যেমন আমাদের প্রক্রিয়া শুরু হবে তেমনি
মৃগাঙ্কও চেষ্টা করবে অমিয়র শক্তি বৃদ্ধি করে রজতের ক্ষতি করার। সুতরাং...
থেমে গেলেন
তিনি। রাঘববাবুর সাথে ঘর থেকে বিদায় নেবার আগে রজতকে আবার সাবধান করে তার গলায়
একটা সুরক্ষা কবচ পড়িয়ে দিলেন। ওরা চলে গেলে রজত বেশ কিছুক্ষণ শিক বাঁকানো খোলা
জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। বাইরে বেশ একটা ঝোড়ো হাওয়া বইছে। গাটা যেন শিরশির করে উঠল তার। জানলার কপাট বন্ধ
করে রজত আবার শুয়ে পড়ল।
বাকি রাতটুকু
নির্বিঘ্নেই কাটলো তার। কিন্তু সকালে উঠে আকাশের অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল
তার। সারা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে।
মুষলধারে না হলেও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বৃষ্টি হয়ে চলেছে আর সাথে বইছে ঝোড়ো
হাওয়া। ইস্ আজ দাদুর টিম ড্রিম ইলেভেনের
খেলা আছে এখানের বুড়ো শিবতলা মাঠে। রজতের
ইচ্ছে ছিল খেলাটা দেখতে যাবার। কিন্তু যেরকম আকাশের অবস্থা দেখছে তাতে মনে হয় না আজ
আর বৃষ্টি কমে খেলাটা হবে অথচ আজ জিতলেই ড্রিম ইলেভেনের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়ে
যেত। একরাশ বিরক্তিতে ভরে গেল রজতের মন। এদিকে আবার সন্ধ্যা হলেই শুরু হবে এক
পৈশাচিক প্রক্রিয়া। রজতের বুকের ভিতরটা আনচান করে উঠল। তার মা জানে না কি ভয়ংকর
প্রক্রিয়ায় রজত অংশ নিতে যাচ্ছে। যদি তার
কিছু হয়ে যায় তাহলে মার কি হবে!কেনিয়াতে একবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে বেঁচেছে। আবার
এখানেও...
বারবার এইসব
অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানার শরিক হওয়াই কি রজতের ভাগ্য!
রজতের এইসব
সাতপাঁচ ভাবনার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলেন তার ছোটদাদু।
- দাদুভাই,
নীচে মাধব এসেছে। চলো, আমাদের দুজনকেই ডাকছে।
দাদুর পিছু
পিছু দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসে রজত। তাকে নিয়ে রাঘববাবু বৈঠকখানায় ঢুকে দরজাটা
বন্ধ করে দেন।
রাত
এগারোটা...পল্লীগ্রামের হিসাবে বেশ রাত। গ্রামের নিস্তব্ধ পরিবেশ, ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্ট যেন এক মায়াবি
পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। প্রায় সারাদিন
বারিবর্ষন করার পরে বৃষ্টিটাও ঝড়েছে। থম মেরে রয়েছে গোটা বিক্রমপুর কোন এক অজানা
শঙ্কায়। প্রায় সমস্ত বাড়িতেই লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়েছে তবে এক প্রান্তে একটি একতলা
বাড়ির ভিতরে কয়েকজন যেন এইমাত্র জেগে উঠেছে।
বাড়িটি হলো মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের। এই মুহূর্তে সেখানে মৃগাঙ্ক ছাড়াও
উপস্থিত রয়েছে অমিয় ও মৃগাঙ্কর কিছু অনুগত লোকজন। লাল সিল্কের ধুতি পড়ে আর লাল
সিল্কের চাদর গায়ে জড়িয়ে একটি আসনে বসে আছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। সামনে অনেকগুলো মোমবাতি দিয়ে সাজানো একটি চতুর্ভূজ। তাতে বেশ কিছু দূর্বোধ্য গানিতিক চিন্হ ও সংকেত
আঁকা রয়েছে। মৃগাঙ্কবাবু একদৃষ্টিতে সেটার
দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। উল্টো দিকে বসে আছে
অমিয়। শান্ত সমাহিত দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে মৃগাঙ্কবাবুর দিকে।
- অমিয়, তোমাকে আমি দানুষ থেকে নরপিশাচ বানিয়েছি
কিসের জন্য সেটা কি তুমি জান?
- জানি।
ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জয় ও মাধব রক্ষিতের কাছ থেকে বুক অফ সোয়েগা নিয়ে আসার জন্য।
- তো এতদিনে
তুমি কি করেছো? যখনই তোমাকে
পাঠাচ্ছি তখনই তুমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছো।
- কি করব আমি? ওই মাধববাবুর ত্রিশূলের সামনে গেলেই
আ...আমার কিরকম যেন সারা গায়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায়। যেন মনে হয় যে আমার সারা গায়ে
যেন কেউ লঙ্কাবাটা ডলে দিয়েছে। অসহ্য সে
জ্বালা মৃগাঙ্কবাবু। আমি পালিয়ে আসতে বাধ্য হই।
ক্ষেপে উঠলেন
যেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য অমিয়র যুক্তি শুনে।
- ওই জন্যই তো
তোমাকে আজ পাঠালাম রাঘব মিত্রের নাতির রক্ত পান করার জন্য। তুমি যদি আজ সফল হতে
অমিয় তাহলে একঢিলে দুই পাখি মারা যেত।
- কিভাবে?
- গর্দভ
কোথাকার! এটাও বুঝতে পারলে না?আজ যে শনিবার...ওই ছেলেটির রক্ত পান করলে তোমার পৈশাচিক শক্তি আজ দ্বিগুণ
হয়ে যেত। তখন মাধব রক্ষিতের ত্রিশূল তোমার কিছুই করতে পারতো না আর সেই সাথে ওই ছেলেটিকে
তোমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ওদের পরিকল্পনাও বানচাল হয়ে যেত। কিন্তু তুমি এমন
অপদার্থ যে আমার সমস্ত পরিকল্পনা...
চুপ করে গেলেন
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। অস্থির হয়ে বলে উঠল
অমিয়- তাহলে আরও একবার যাই আজ। রাত তো এখনও অনেক বাকি!
- চুপ করো
অর্বাচীন। এখন গিয়ে কিছুই করতে পারবে না তুমি। আমার অনুচরেরা খবর নিয়ে এসেছে...
মাধব রক্ষিত আর রাঘব মিত্র বুক অফ সোয়েগার সাহায্যে ওই ছেলেটিকে দানুষে রূপান্তরিত
করছে তোমায় জব্দ করার জন্য আর সেই প্রক্রিয়া এতক্ষণে সম্পূর্ন হয়েছে। এখন ক্রিকেট
মাঠেই তোমায় ওই ছেলেটির মোকাবিলা করতে হবে।
- কিন্তু
মৃগাঙ্কবাবু, ও যদি আমার মতো
দানুষে রূপান্তরিত হয়ে থাকে তাহলে তো ওর আর আমার শক্তি সমান হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে
ওকে ম্যাচেই বা কিভাবে হারাবো আমি?
ঘর কাঁপিয়ে
অট্টহাস্য করে উঠলেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য।
- ক্রিকেট
ম্যাচ খেলার জন্য ও দানুষ হয়েছে। ওর শক্তি মাঠেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তুমি হয়েছো
পিশাচ। অনেক ছলাকলা তোমার জানা আছে। ম্যাচ চলার সময় তোমার দৃষ্টি, তোমার নিঃশ্বাস...সবকিছুর সাহায্যে ওই
ছেলেটির মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তুমি। যদি সেটা করতে পারো তাহলে ম্যাচ
জেতা নিয়ে কোন সংশয় কি থাকবে অমিয়?
উজ্জ্বল হয়ে
উঠল অমিয়র চোখদুটো।
- আপনি ঠিকই
বলেছেন। ওর মগজকে কবজা করে ওকে মাঠে এমন হেনস্থা করবো যে ও জীবনে কোনদিন আর
মাঠমুখো হবে না।
প্রবল হাসিতে
ফেটে পড়ল অমিয় ও মৃগাঙ্ক দুজনেই। হাসতে
হাসতেই হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন মৃগাঙ্কবাবু।
সোজা অমিয়র
চোখের দিকে তাকিয়ে বজ্রকঠিন স্বরে বললেন- জিততে তোমাকে হবেই অমিয়। যখনই তুমি জিতবে
তখনই তোমার পূর্ণ শক্তির বিকিরণ হবে যার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। তখন তুমি
মাধবের কাছ থেকে অনায়াসে ছিনিয়ে আনতে পারবে বুক অফ সোয়েগা। পৃথিবীর সেরা তন্ত্রবিদ্যা, জাদুবিদ্যা লিপিবদ্ধ আছে তাতে। ওর সাহায্যে তুমি আর আমি মহাশক্তিশালী হয়ে উঠব।
কোন পার্থিব শক্তি আমাদের কিছুই করতে পারবে না।
এবার গলাটা
একদম খাদে নামিয়ে হিসহিস করে বলে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু- আর যদি না পারো, আমি নিজে হাতে তোমাকে পচিয়ে মারবো। পিশাচের
জীবন থেকে কোনদিন মুক্তি পাবে না তুমি।
মৃগাঙ্ক
ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে আমরা এবার সোজা চলে যাব রাঘব মিত্রের বাড়ি যেখানে দোতলার
ঘরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে রজত। কাল মাঝরাত অবধি মাধব রক্ষিত ও ছোটদাদুর সাথে বৈঠকখানা
ঘরেই ছিল সে। অনেক উপাচার পালন করার পর সে নিজের ঘরে এসে বিশ্রাম নেয়। ভোরের আলো
এখন অল্প অল্প ফুটছে। গতকাল সারাদিন প্রায়
বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আজ আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার।
আরো কিছুক্ষণ পরে নিজের মোবাইলে রিচি বেনোর কমেন্ট্রীর অ্যালার্ম টোনে ঘুম
ভাঙে রজতের। আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসে সে। মাথাটা অসম্ভব ভার লাগছে তার। ধীরে
ধীরে মনে আসে গতরাতের কথা। বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। খুলে দেয়
কপাট। ভোরের শীতল হাওয়া রজতের মুখে এসে লাগে। ভারী আরাম বোধ করে সে। জানলা দিয়ে
তাকিয়ে দেখতে থাকে এই পল্লীগ্রামের প্রকৃতিকে। অনুভব করতে থাকে তার আস্তে আস্তে
জেগে ওঠাকে। আজ থেকে তার মিশন শুরু। হ্যাঁ, মিশন...ছোটদাদু যে মিশনের নাম
দিয়েছে "মিশন ফাইনাল ওভার"।
গতকাল রাতে
বৈঠকখানায় মাধববাবু ও ছোটদাদুর আয়োজন দেখে সে অবাক হয়ে গেছিল। মাধববাবু বুক অফ
সোয়েগা হাতে নিয়ে রজতকে বলে- রজত, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে তোমাকেও অমিয়র মতো পৈশাচিক পদ্ধতিতে দানুষ বানিয়ে
তুলতে হবে আমায় যাতে তুমি ওই শয়তানের মোকাবিলা করতে পারো। কিন্তু গত কয়েকদিনের
অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আমি এই বইয়ের আরো কিছু লেখার পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি। তার থেকে আমি জেনেছি যে কোন শয়তান বা দানুষের
কোন বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হলে কিভাবে তাকে আবার নিস্ক্রিয় করা যায়।
রজগ উৎসাহিত
হয়ে বলে - তার মানে আমাকে ওই জঘন্য রিচুয়ালস পালন করতে হবে না? দানুষ হতে হবে না আমায়?
মাধববাবু-
হুমম্, তা হয়তো হবে না কিন্তু
রজত যা করতে হবে তোমাকেই করতে হবে। তোমাকেই ক্রিকেট মাঠে খেলার মাধ্যমে ওকে হারাতে
হবে। চূর্নবিচূর্ন করতে হবে ওর অহংকারকে।
যদি পারো তাহলে তুমি তো জিতবেই তার সাথে হয়তো বেচারা অমিয়রও এই দুঃসহ অবস্থা থেকে
মুক্তি ঘটবে। বেঁচে যাবে ও।
রজত- নিশ্চয়ই
পারবো। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই করবো। তাতে যদি অমিয়র পিশাচ দশা থেকে মুক্তি
ঘটে তার থেকে ভালো কিছু হয় না।
মাধব- সেই
পদ্ধতিটিও কিন্তু খুব সোজা নয় রজত। যথেষ্ট কঠিন এবং তোমার জীবনের আশংকাও আছে।
রজত- যত কঠিনই
হোক আপনি বলুন। ব্যাট বা বল হাতে ক্রিকেট মাঠে নামলে আমি কোন কঠিন পরীক্ষাতেই ভয়
পাই না।
মাধব- বেশ বোসো
তবে আমার সামনে। রাঘবদা আপনিও বসুন। আমি যেভাবে বলব সেভাবেই আপনারা কাজ করবেন।
বৈঠকখানার
মাঝখানে তিনজনে বসলো। একদিকে পাশাপাশি রজত ও তার ছোটদাদু। অন্যদিকে মাধব রক্ষিত। তাদের মাঝখানে চারটে
মোমবাতি দিয়ে ঘেরা একটা চৌকো জায়গা। মাধববাবু চারটে মোমবাতিতেই অগ্নিসংযোগ
করলেন। চৌকো অংশটিতে রাখলেন দুটি ছোটো
কাঠের বাক্স। তার ইশারায় রাঘববাবু নিপুন হাতে ইনজেকশন দিয়ে রজতের হাত থেকে কয়েক
আউন্স রক্ত সংগ্রহ করলো। মাধববাবু সেই রক্ত একটি ছোট গ্লাসে ভরে রাঘববাবুর দিকে
এগিয়ে দিলেন। রজত হতবাক হয়ে দেখল যে তার দাদু এক নিঃশ্বাসে সেই রক্ত পান করে নিল।
অতঃপর মাধববাবু দুজনকেই সামনে রাখা দুটো বাক্সের উপর নিজেদের ডান হাত প্রতিস্থাপন
করতে বললেন। তারপর নিজের কোলের উপর বুক অফ সোয়েগা খুলে বললেন -
রজত, যে প্রক্রিয়া আমরা এখন করতে যাচ্ছি সেটার
নাম দ্বৈত সত্বার জাগরন। রাঘবদা তোমার রক্ত পান করেছে। পিশাচ শক্তির জাগরনের জন্য তিনি এখন প্রস্তুত।
এই বইয়ে বর্নিত মন্ত্রোচ্চারন করে তার অলৌকিক শক্তিকে আমি তো জাগিয়ে তুলবই কিন্তু
সেই শক্তিকে চালিত করবো তোমার মধ্যে অর্থাৎ একই সঙ্গে তোমার মধ্যে যেমন রজতের
সত্তা থাকবে তেমনি মনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকবে রাঘব মিত্রের পৈশাচিক সত্তা। তোমার নিজস্ব সত্বা যখন বিপন্ন হবে তখনই
রাঘবদার সত্বার বহিঃপ্রকাশ হবে।
অমিয়র সাথে
ক্রিকেট ম্যাচের সময় অমিয় তার শক্তিবলে নিশ্চিত ভাবে তোমার মনের উপর প্রভুত্ব
বিস্তার করবে। সে ভাববে যে তুমি তার দখলে কিন্তু তার অগোচরে রাঘবদার সত্বা সেই
মুহুর্তে তোমার ভিতর জাগ্রত হবে যে তখন তার ক্ষমতাবলে অমিয়র শক্তিকে ধূলিসাৎ করবে।
অমিয় একইসাথে দুটি মনের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারবে না।
এই পর্যন্ত বলে
থামলেন মাধববাবু।
- যখনই অমিয়
পরাজিত হবে তখনই তোমার মনের উপর থেকে তার প্রভাব নষ্ট হবে। কিন্তু রজত, তোমার সত্বাকে আবার তোমার মধ্যে নিয়ে আসতে
গেলে তখনই তোমায় নিজের অঙ্গে আঘাত করে রক্তপাত ঘটাতে হবে। এই কাজে বিন্দুমাত্র
দেরি হলে চিরদিনের মতো তোমার মধ্যে রাঘবদার সত্বা বেঁচে থাকবে। যতক্ষণ জেনে রাখো,
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পরমুহূর্তে থেকে রাঘবদার দেহ মৃত শরীরের
ন্যায় এখানেই শোয়ানো থাকবে। যদি তুমি সফল হও তাহলেই উনি আবার জেগে উঠবেন। নইলে নয়...
তোমরা প্রস্তুত
তো?
রজত ও তার
ছোটদাদু একবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর দুজনেই জানালো যে তারা
প্রস্তুত।
এক দুর্বোধ্য
ভাষায় মন্ত্রোচ্চারন শুরু করলেন মাধববাবু। রজতের সেটা বোধগম্য না হলেও সে আস্তে
আস্তে বুঝতে পারলো যে ওই মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই তার কানে ঢুকছে না। প্রকৃতি যেন তার
সমস্ত শব্দকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। বেশ
কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর রজত দেখল যে ছোটদাদুর হাত থেকে একটা কালো ধোঁয়ার প্রলেপ
উত্থিত হচ্ছে আর সেই ধোঁয়ার প্রলেপ আস্তে আস্তে কুন্ডলী পাকিয়ে একটা সরলরেখা
অনুসরন করে রজতের হাতের উপর পতিত হচ্ছে।
ধোঁয়ার অগ্রভাব তার হাত স্পর্শ করা মাত্রই একসাথে অনেকগুলো সুঁচ ফোটার
অনুভূতি টের পেল সে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ধোঁয়ার অংশ তার হাতের ভিতর প্রবেশ করার
পরেই রজতের একটা মিশ্র অনুভূতি হলো। হাতের অংশে সুঁচ ফোটা বন্ধ হলেও সারা শরীরে
যেন এবার সুঁচ ফুটতে লাগল। অস্থির হয়ে উঠল সে। পাশে তাকিয়ে দেখল যে তার ছোটদাদু
অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন মেঝেতে। এই সময়
রজতের সারা শরীর একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
রজত দেখল যে ঝাঁকুনির পর তার সব জ্বালা যন্ত্রণা ব্যাথা কমে গেছে। সামনে তাকিয়ে দেখল মাধববাবু একটা স্মিত হাসি
নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে।
- আমাদের কাজ
শেষ হয়েছে রজত। এসো, আমরা
রাঘবদাকে ধরে সোফায় শুইয়ে দি। আজ থেকে যতক্ষন পর্যন্ত না তুমি অমিয়র সাথে ম্যাচ
শেষ না করছো ততক্ষণ উনি এভাবেই অচেতন থাকবেন বা বলতে পারো ঘুমের দেশে বিচরণ করবেন।
আমি এই স্থানে ওনার পাহারাদার হিসাবে থাকব। সুতরাং বুঝতেই পারছো যে অমিয়কে তোমায়
একলাই সামলাতে হবে। তবে চিন্তা নেই, নিতাই তোমার সাথে সবসময়
থাকবে। কাল বাদ দিয়ে পরশু ফাইনাল খেলা। কাল নিতাই তোমায় রাঘবদার টিমের প্র্যাকটিসে
নিয়ে যাবে। এখন যাও, বিশ্রাম নাও।
"দাদাবাবু, আপনি উঠেছেন?
এই নিন আপনার
চা..."
নিতাইএর ডাকে
গতরাতের ঘটনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো রজত। জানলা থেকে এগিয়ে এসে নিতাইএর হাত থেকে
চায়ের কাপটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- আচ্ছা নিতাইদা, আমরা কখন যাব প্র্যাকটিসে?
নিতাই- আজ্ঞে,
ছেলেরা তো একটু বেলার দিকেই মাঠে জড়ো হয়। চিন্তা করবেন না, আমি আপনার জন্য একটু জলখাবারের ব্যবস্থা করে আপনাকে মাঠে নিয়ে যাব।
ড্রিম ইলেভেন
টিমের প্র্যাকটিসে এসে রজতের বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লীগের
দৌলতে রজতের মুখ এখন অনেকেই চেনে। টিমের সবাই এটা ভেবেই আনন্দিত যে ফার্স্ট ক্লাস
ক্রিকেট খেলা একজন খেলোয়ার তাদের হয়ে খেলবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রজত তাদের সাথে সুন্দরভাবে মিশে গেল। ব্যাট ও বল হাতে
হালকা অভ্যাসের পর ছেলেদের একসাথে করে আগামীকালের ফাইনাল নিয়ে একটু আলোচনায়
ব্যাস্ত ছিল রজত। হটাৎ তার নাম ধরে কেউ ডাকায় রজতের আলোচনায় ব্যাঘাত পড়লো। কিন্তু
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। অমিয়...অমিয় তাকে ডাকছে মাঠের ধারে
দাঁড়িয়ে। রজত লক্ষ্য করলো যে অমিয়র আবির্ভাবের
সাথে সাথেই ড্রিম ইলেভেনের বেশীরভাগ ছেলেদের মুখ ভয়ে যেন শুকিয়ে গেছে। তাদেরকে বসতে বলে রজত এগিয়ে এলো অমিয়র দিকে।
- কাল তাহলে
রাঘব মিত্রের তৈরি করা দানুষ হিসাবে তুমি নামছো আমায় আটকাতে?
কোমরে হাত দিয়ে
চরম ঔদ্ধত্যপূর্ন ভাবে রজতকে জিজ্ঞাসা করলো অমিয়।
অমিয়কে
আপাদমস্তক একবার দেখে নিল রজত। দুই হাতের মধ্যে লাল ক্রিকেট বলটা নিয়ে লোফালুফি
করতে করতে সে বলল- আমি নামবো ক্রিকেট খেলতে। তোমার মতো পিশাচকে বুঝিয়ে দিতে যে
অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে জয়ী হওয়া যায় না।
হাত তুলে রজতকে
থামিয়ে দিল অমিয়।
- ওইসব মেকি
কথার কোন দরকার নেই। তোমার দাদু ও তার বন্ধু তোমায় দাঁড় করিয়েছে তো আমার বিরুদ্ধে? তাহলে এসো, শুধু আমরা
দুজন মুখোমুখি হই। শুধু শুধু বাকি ২০ জন খেলোয়ারকে জড়িয়ে লাভ কি!
শোন রজত, আমি তোমায় চ্যালেন্জ করছি, এই ওয়ান ইজ টু ওয়ান মোকাবিলায় যদি আমি জিতি তো তুমি কাল সকালেই এই গ্রাম
ছেড়ে চলে যাবে। আর যদি তুমি জেতো তাহলে আমি কথা দিচ্ছি যে কালকের ফাইনালে আমি
খেলবো না।
অমিয়র চোখের
পলক পড়ার আগেই রজত বলল- আমি তোমার চ্যালেন্জ গ্রহন
করলাম। কিন্তু কি
পদ্ধতিতে হবে এই মোকাবিলা?
অমিয়- খুব সহজ
পদ্ধতি হবে। এক ওভারের খেলা। তুমি এটাকে সুপার ওভারও বলতে পারো। তুমি
আর আমি এক ওভার করে ব্যাট ও বল করবো অর্থাৎ আমি যখন ব্যাট করবো তুমি বল করবে আর
তুমি ব্যাট করার সময় আমি বল করবো।
রজত- কিন্তু
ফিল্ডিং করবে কারা?
অমিয় ঠোঁটের
কোনে একটা বিশ্রী হাসি ফুটিয়ে উঠে বলল- তোমার ব্যাটিংএর সময়ে বুলেটস ইলেভেন আর
আমার সময় ড্রিম ইলেভেন।
রজত কয়েক
সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল- বেশ আমি রাজি। কিন্তু কখন হবে এই সুপার ওভারের খেলা?
অমিয় একেবারে কাছে চলে এল রজতের। হিসহিস করে বলে উঠল- রাত ১২টায়।
চমকে উঠল রজত। তার চমকানোটা দৃষ্টি এড়ালো না অমিয়র।
- ভয় পেলে নাকি মিঃ রজত রায়?
নিজেকে সামলে নিল রজত। গম্ভীরভাবে উত্তর দিল- না অমিয়, ভয় পেলে আর তোমার বিরুদ্ধে খেলতে রাজি হই
কি করে? ঠিক সময় মতো আমি সব ব্যবস্থা করে চলে আসবো। তোমার
দিকের ব্যবস্থা তুমি করে নাও।
এই কথা বলে আর দাঁড়ালো না রজত। সোজা উল্টো দিকে ঘুরে নিজের টিমের কাছে পৌঁছে
গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করলো অমিয়। তারপর সেও ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা লাগালো
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের বাড়ির দিকে।
বাড়ি ফেরার পরে রজতের মুখে সব কথা শোনার পর মাধববাবু স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রজত
তাকে বলল- কি ব্যাপার, আপনি
এত চিন্তা করছেন কেন?
মাধববাবু - অমিয় হঠাৎ এইরকম প্রস্তাব তোমাকে দিল কেনো সেটা বুঝতে পারছো রজত?
রাত ১২টার পর অমিয়র পিশাচশক্তি সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করবে। আমার চিন্তা
হচ্ছে তোমায় নিয়ে যে ঝুঁকি আমরা নিয়েছি সেটা সফল হবে তো?
রজত- অত চিন্তা করবেন না। একটা শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি লড়বো। দেখবেন অমিয়কে আমি
হারাবোই আর দাদুকেও দুশ্চিন্তামুক্ত করবো।
ধীরে ধীরে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হলো। দুটি ক্লাবের ছেলেরাই রাতের এই সুপার
ওভার ম্যাচের জন্য মাঠে উপযুক্ত লাইটের ব্যাবস্থা করা থেকে শুরু করে নাকি আয়োজনও
সম্পূর্ণ করে ফেলল। বিক্রমপুরের লোকেরা পুরো ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকলেও
মাঠের আয়োজন দেখে মাঠের ধারে ভিড় জমাতে লাগলো। সময়মতো রজত ও ড্রিম ইলেভেনের বাকি
খেলোয়াড়েরা মাঠে পৌঁছে গেল। ইতিমধ্যেই অমিয় ও বুলেটস ইলেভেনের খেলোয়াড়েরাও সেখানে
পৌঁছে গেছে। মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য ও অমিয়
পাশাপাশি মাঠের পাশে দুটো চেয়ারে বসে আছে।
দুই অ্যাম্পায়ার মাঠের মাঝখানে পৌঁছে ডেকে নিলেন দুই যুযুধান প্রতিপক্ষকে।
সুপার ওভারের সব নিয়ম বুঝিয়ে দিয়ে টস হলো। টসে জিতলো অমিয়। জানিয়ে দিল যে সুপার
ওভারে সে প্রথমে ব্যাট করবে। রজত মনে মনে
একটু খুশিই হলো। একটা নির্দিষ্ট টার্গেটের পিছনে ধাওয়া করবে সে। ড্রিম ইলেভেনের
খেলোয়াড়দের নিয়ে ফিল্ডিং সাজিয়ে নিল সে। এবার সতর্ক থাকতে হবে তাকে। অমিয় নামছে
ব্যাট হাতে। নিশ্চয় তার পিশাচশক্তি দিয়ে
রজতকে বশ করতে চাইবে সে। তাকে চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ সম্ভব অমিয়কে এড়িয়ে থাকার।
একবার বশ হয়ে গেলে তার মধ্যে আর রজত নয়, রাঘব মিত্রের সত্বা কাজ করবে।
অন্তত বোলিংয়ের সময় তো তাকে রজত হয়েই থাকতে হবে। ছোটদাদু ব্যাট খারাপ করতো না
কিন্তু বল কি করতে পারতো!
সেকথা জানার এই মুহুর্তে কোন উপায় নেই।
ছোটদাদুর নিশ্চল শরীরটা এখন তার অট্টালিকার ঘরে চুপচাপ শায়িত। রজতের উপরই
নির্ভর করছে তার ভাগ্য।
মাঠের চারিদিকে চেয়ে ফিল্ড পজিশনটা একবার দেখে নিল সে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে
কখনও কখনও বল করেছে সে আবার ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লিগেও দুই একটা ম্যাচে দু এক ওভার
হাত ঘুরিয়েছে কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ ব্যাটিং ক্রিজে কোন সাধারণ
ব্যাটসম্যান দাঁড়িয়ে নেই। পিশাচশক্তিতে বলীয়ান এক দানুষ দাঁড়িয়ে।
রজত কি পারবে ঝানু প্রফেশনাল বোলারের মতো বোলিং করে অমিয়কে আটকাতে?
অ্যাম্পায়ার প্লে সংকেত দেওয়া মাত্র বোলিং প্রান্ত থেকে দৌড় শুরু করলো রজত।
ব্যাটটা একটু তুলে গ্রাহাম গুচ বা রবি শাস্ত্রীর স্টাইলে দাঁড়িয়ে অমিয়। রজতের
প্রথম বলটা অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পড়ে হালকা বাঁক নিল হাওয়ায়। সুইংটা বুঝতে
দেরি করে ফ্যালে অমিয়। হাওয়ায় সজোরে ব্যাট
চালালেও বলের নাগাল পায় না। ড্রিম ইলেভেনের ফিল্ডাররা হাততালি দিয়ে ওঠে। প্রথম বল মিস করায় অমিয়র চোখে যেন আগুন জ্বলে
ওঠে। বোলিং ক্রিজের দিকে ফিরে যাওয়া রজতের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে।
রজতের পরের বলটার অবশ্য মাঠের বাইরে স্থান হলো। অমিয়কে চমকাবার জন্য বলটা
বাউন্সার দিয়েছিল সে। এবারেও বুঝতে ভুল হয় অমিয়র। আগেই ফ্রন্টফুটে কমিটেড হয়ে
গেছিল সে। কিন্তু তারপর চোখের পলকে ব্যাকফুটে শরীরটা কনভার্ট করে সে যখন হুক করলো
রজত স্তম্ভিত হয়ে গেল। অত দ্রুত শারীরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন কোন সাধারণ মানুষ
করতে পারে না সেটা সে বুঝতে পারলো।
তৃতীয় বলটা একই
অ্যাকশানে স্লোয়ার দিল সে। এবার কিন্তু আবার অমিয়কে ঠকাতে সক্ষম হলো রজত। অমিয়র
বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে বল উইকেটরক্ষকের হাতে নিরাপদে জমা পড়ল।
প্রমাদ গুনল
অমিয়। তিনবল হয়ে গেছে আর তার রান ছয়। মাঠের বাইরে বসে থাকা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের
সাথে একবার যেন চোখাচোখি হয়ে গেল অমিয়র।
বোলিং ক্রিজে
গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো রজত তার ওভারের চতুর্থ বলটা করার জন্য। অমিয় কিন্তু ব্যাটটা তার পায়ে ঠেকিয়ে হাতের
গ্লাভসগুলো খুলে লাগাচ্ছে। যদিও দৃষ্টি
কিন্তু সামনের দিকে। একটু অপেক্ষা করলো রজত। সময় দিল অমিয়কে গুছিয়ে নেওয়ার আর এটাই
তার ভুল হলো। দাঁড়িয়ে থাকার ছলে অমিয় ইতিমধ্যেই রজতকে বশ করার চেষ্টা শুরু
করেছে। হাতের গ্লাভস পড়বার অছিলায় হাতের
তালু থেকে উৎপন্ন করেছে হালকা কালো ধোঁয়া।
কালো পাতলা সুতোর মতো সেই ধোঁয়া বাতাসে ভাসতে ভাসতে রজতের কাছে এসে তার
মস্তিষ্কে বিলীন হয়ে গেল।
একটা যেন ঝটকা
লাগলো রজতের। চমক ভাঙার মতো সে দেখল যে বল হাতে সে চুপচাপ বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে
অথচ অমিয় ব্যাট হাতে প্রস্তুত। আর দেরি না করে দৌড়োতে শুরু করলো সে। একটা মশার
গুনগুন করার শব্দ যেন তার কানে আসছে। যত ব্যাটিং ক্রিজের কাছে পৌঁছচ্ছে তত যেন
গুনগুনানিটা পরিষ্কার হচ্ছে।
"ফুলটস
দাও, আমায় ফুলটস
দাও"...স্পষ্ট শুনতে পেল সে।
অমিয়র কাছে
চতুর্থ বলটা ফুলটসই এলো। পরম আনন্দে বলটা আবার মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিল সে। মাথা নীচু করে আবার বোলিং মার্কে ফিরছে রজত।
কানের মধ্যে সেই গুনগুনানি।
"সাবাস
রজত, সাবাস। আবার দাও ফুলটস।
আমি অপেক্ষা করছি। দাও ফুলটস"
মাথাটা ঝাঁকিয়ে
বোলিং মার্কে পৌঁছে ঘুরলো সে।
পঞ্চম বলের
পরিনতিও ওভার বাউন্ডারিই হলো কারন রজত এবারেও ফুলটস দিয়েছিল। বলটা করার পর বিস্মিত
হয় সে। বারবার ফুলটস দিচ্ছে কেন সে! হঠাৎ শরীরে যেন শিহরন খেলে যায় তার। অমিয় তার
স্বত্বার উপর কব্জা করেছে। তাই তারই
মনোমতো বল করে যাচ্ছে সে।
নাঃ আর দেরি
করা যাবে না। জাগিয়ে তুলতে হবে রাঘব মিত্রের স্বত্বা তার ভিতরে। মনে মনে মাধব রক্ষিতের দেওয়া পদ্ধতি অনুসারে
ছোটদাদুকে স্মরন করলো সে।
নিজের বোলিং
মার্কে পৌঁছে অমিয়র দিকে পিছন ফিরে হাঁটু গেড়ে বসলো রজত। মাথাটা নীচু করে বসে রইলো
সে। তাকে ওই অবস্থায় দেখে অ্যাম্পায়ার এবং
ফিল্ডাররা ছুটে এলো তার কাছে। এরিমধ্যে
উঠে দাঁড়িয়েছে রজত। হাত নেড়ে বাকি খেলোয়াড় এবং অ্যাম্পায়ারদের আশ্বস্ত করলো সে।
গোটা ঘটনায় অমিয় অবশ্য নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।
বোলিং মার্কে
দাঁড়িয়ে অমিয়র দিকে তাকালো রজত। দূর থেকে বুঝতে পারলো যে বিড়বিড় করছে অমিয় অর্থাৎ
তার ইচ্ছেমতো বল করার জন্য প্রভাবিত করছে রজতকে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে
গেলো রজতের। শুনতে পাচ্ছে না সে আর অমিয়র
নির্দেশবানী বরং তার পাখির চোখ এখন নিবদ্ধ
ব্যাটসম্যান অমিয়র তিনটি স্ট্যাম্পের উপর। দৌড় শুরু করলো রজত। অমিয় কিন্তু বুঝতেই
পারলো না যে এই মুহুর্তে তাকে বল করতে আসছে রজত রায় নয়, আসছে রজতের দ্বিতীয় স্বত্বা রাঘব
মিত্র। এক দানুষ আসছে আর এক দানুষের টক্কর
নিতে।
গোটা মাঠ এরপর
দেখল যে অমিয়কে শেষ কয়েকটা ম্যাচে কেউ আউট করতে পারেনি, যে অমিয়র ব্যাটিং শেষ কয়েকটা ম্যাচে
অতিমানবীয় লেগেছিল সেই অমিয়র উইকেট ছিটকে দিল রজতের ইনসুইংগার ডেলিভারি।
আত্মবিশ্বাসী
অমিয় তৈরি ছিল রজতের ফুলটসের জন্য কারন সে জানত যে তার নির্দেশ মেনে রজত ফুলটসই
করবে কিন্তু রজতের হাত থেকে বেরোলো বিষাক্ত ইনসুইং ডেলিভারি যেটা হতভম্ব অমিয়কে
পরাস্ত করে তার উইকেটের পতন ঘটালো। সেই সাথে ওভার শেষ এবং ১০ মিনিটের বিরতি।
ড্রিম ইলেভেনের
খেলোয়াড়েরা রজতকে জড়িয়ে ধরে যখন সেলিব্রেশনে ব্যাস্ত তখন মাঠের ধারে চুপচাপ বসে
বিস্মিত অমিয়। কি হলো ব্যাপারটা! রজতকে তো সে বশীভূত করে ফেলেছিল তাহলে শেষ বলে
তার নির্দেশ খাটলো না কেন?
অমিয় ভালোমতোই
জানে যে শক্তি মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য তাকে দিয়েছে রজতের শক্তি তার থেকে বেশী নয়।
তাহলে! নাঃ নিশ্চয়ই অমিয়র কোন ভুলের জন্যই এটা হলো। কুছ পরোয়া নেহি...এবার তো রজত
ব্যাট করবে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে এবার
অমিয়। জিততে হলে রজতকে এক ওভারে ১৯ রান করতে হবে। মনে মনে হাসলো
অমিয়। প্রথম বলেই রজতকে নির্দেশ দিয়ে ক্যাচ তোলাবে সে। শুধু একটাই শঙ্কা তার মনে। বোলিং অমিয় কোনদিনই করেনি। এলোমেলো বল না করে
শুধু জায়গামতো তিন স্ট্যাম্পের মধ্যে রাখতে হবে বলটা। বাকি কাজ করবে তার শক্তি।
বিরতির পরে
খেলা শুরু হতে আর কিছু সময় বাকি। প্যাড, গ্লাভস পরে রজত মোটামুটি তৈরি।
ব্যাট হাতে একটু শ্যাডো করে নিতে গিয়ে গোলমালটা টের পেল সে। ডানহাতে
ব্যাটিং স্টান্স নিতে গিয়ে সে দেখল যে প্রচন্ড আড়ষ্ট লাগছে নিজেকে। যেন প্রথমবার
ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়েছে সে। পা আগুপিছু করতে গিয়ে দেখল সেখানেও একই সমস্যা। বাঁ
পাটা যেন নড়ছেই না। স্ট্রোকের শ্যাডো করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো যে অত্যন্ত আনাড়ির মতো
হচ্ছে ব্যাপারটা। এবারে ঘামতে লাগলো রজত। হালকা একটা ভয়ের শিরশিরানি তার ঘাড় বেয়ে
পিঠের দিকে নামতে লাগলো। তাহলে কি অমিয় তার দ্বিতীয় স্বত্বাকেও বশীভূত করে ফেলল?
কিন্তু তা কি করে সম্ভব! অমিয়র তো এটা বুঝতে পারারই কথা নয়। হঠাৎ
চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা রজতের মাথায় ঝিলিক মেরে গেল। ডানহাতের বদলে এবার বাঁ
হাতে স্টান্স নিল সে। ব্যাস, এক লহমায় সব বাধা যেন দূরীভূত
হলো। অনায়াস ভঙ্গিতে সে শ্যাডো করতে পারছে।
ডান পা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুভমেন্ট করছে।
ছোটদাদু ভালো ব্যাট
করতো সে শুনেছিল কিন্তু সে যে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান ছিল সেটা রজত এই মুহুর্তে
আবিষ্কার করলো। এই কারনেই রাঘব মিত্রের স্বত্বা তাকে ডানহাতে ব্যাট করতে দিচ্ছিলো
না। চলো অমিয়...তোমার প্রতিদ্বন্ধী তৈরি।
ক্রিজে গিয়ে
স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালো রজত রায়। আজ তার জীবনের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। মহাকালের ওপারে গিয়ে ডেথ ইলেভেনের হয়ে খেলা ১৭৫
অথবা কেনিয়ায় আঞ্চলিক দলের হয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিকের বিরুদ্ধে করা ১৮৩ রানের চেয়েও
কঠিন হয়তো আজকের এই সুপার ওভার। এখানে ব্যর্থ হলে শুধু তার নয়, তার ছোটদাদুর ও এই গ্রামের আরও অনেকের জীবন
বিপন্ন হয়ে পড়বে। পারতেই হবে তাকে...এই মন্ত্রে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সামনে তাকালো
রজত।
বোলিং মার্কে
দাঁড়িয়ে অমিয়। বলটা নিয়ে আস্তে আস্তে প্যান্টে ঘষছে সে। কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে
তাকিয়ে রজতের দিকে। অ্যাম্পায়ার সংকেত দিতেই দৌড় শুরু করলো অমিয়। অবশ্য খুব সামান্য রান আপ তার। রজত দেখল যে
বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে আসছে অমিয়। রজত দেখল যে প্রথম বলটা পড়ল গুড লেংথ স্পটে।
মিডিয়াম গতির বলটা রজত অনায়াস ভঙ্গিতে ডান পা বাড়িয়ে এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে
পাঠিয়ে দিল মাঠের বাইরে। চারিদিকে
হাততালির আওয়াজের মধ্যে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অমিয়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে
পারছে না সে। পিশাচশক্তিতে বলীয়ান অমিয় বল করার সময় তার বশীভূত রজতের উদ্দেশ্যে
বলেছিল আড়াআড়ি ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হবার কথা।
তা না হয়ে রজত সেটা ওভার বাউন্ডারি মেরেছে। একটু যেন ঘাবড়ে গেল অমিয়। অপলক দৃষ্টিতে দেখছে
রজতকে। ঘন ঘন ঠোঁট চাটছে সে। রজত বুঝতে পারছে যে ভিতর থেকে দুর্বল হচ্ছে অমিয়।
কাম অন
ছোটদাদু...আবার মারতে হবে অমিয়কে। তার উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানলেই আসবে জয়।
অমিয় দ্বিতীয়
বলটা করলো তার সমস্ত অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে। অবিশ্বাস্য চোখে রজত দেখল যে বলটা
অফস্ট্যাম্পের বাইরে পড়ে তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল। উইকেট কিপার নাগাল পেল না সেই
বলের। চোখের নিমেষে বল থার্ডম্যান বাউন্ডারি পেরিয়ে গেল। অ্যাম্পায়ার বাউন্ডারির
সিগনাল দিতে নিজের মাথার চুল জোরে চেপে ধরলো অমিয়। বুলেটস ইলেভেনের ফিল্ডাররা দৌড়ে
গেল তার কাছে। অমিয়কে বল স্ট্যাম্পে রাখার
পরামর্শ দিল তারা। ক্রিজে দাঁড়ানো রজতও বুঝতে পারলো যে অমিয়র লাস্ট বল স্ট্যাম্পে
থাকলে সেটা আনপ্লেয়েবেল হতো। শুধু অমিয় কোনকালেই বল করে না বলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে
পারছে না। অমিয়র অতিমানবীয় শক্তির কাছে দানুষ রূপী রজতের শক্তি অনেক কম।
স্কোরবোর্ডে
দেখাচ্ছে রজতের স্কোর ১০। আরও ৯ রান দরকার জিততে আর বল বাকি ৪ কিন্তু এই ৪ বলের যে
কোন একটা হয়ে উঠতে পারে রজতের মৃত্যুবান।
ওভারের তৃতীয়
বলটা স্ট্যাম্প লাইনেই রাখলো অমিয় তবে একটু শর্ট অফ লেংথ। রজত আগেই অনুমান করেছিল। বল পড়ে বুলেটের গতিতে এলেও সে ডিফেন্স করতে
সমর্থ হলো যদিও বল রজতের ব্যাটে লাগার সাথে সাথে দারুন ঝটকা খেল সে। বলের গতি এত
তীব্র ছিল যে রজতের হাত থেকে কাঁধ অবধি ব্যাথায় ঝনঝন করে উঠলো। কিন্তু অমিয়র
বিরক্তি ভরা আওয়াজ শুনে দেখল যে অ্যাম্পায়ার ওভার স্টেপিং এর জন্য নো বল ডেকেছে।
হতাশ অমিয় ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার অ্যাম্পায়ার আর একবার রজতের দিকে দেখতে
লাগল। কিছুটা হলেও বাগে পাওয়া গেছে অমিয়কে
বুঝতে পারলো রজত। বোলিং মার্কের দিকে ফিরে যাওয়া অমিয়র উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল
রজত।
- নেক্সট বল
আবার মাঠের বাইরে পাঠাবো অমিয়।
ফ্যালফ্যাল করে
রজতের দিকে ফিরে চাইলো অমিয়। তার পরের বলে বোঝা গেল যে রজত তাকে অনেকটাই বিভ্রান্ত
করতে পেরেছে। মিডল এবং লেগ স্ট্যাম্প ঘেঁষে পড়া তড়িৎ গতির বলটায় রজত শুধু ব্যাটটা
ছুঁইয়ে দিয়েছিল। ফাইন লেগের উপর দিয়ে বল মাঠের বাইরে অর্থাৎ রজতের রান ১৭...জেতার
জন্য দরকার দুই রান আর হাতে আছে তিন বল।
এবার কিন্তু
অমিয়কে দেখে কিছুটা দিশাহারা মনে হচ্ছে।
চোয়াল ঝুলে পড়েছে তার। অস্থির লাগছে তাকে। দেখে মনে হচ্ছে খেলার এই মুখোশ
সরিয়ে পারলে এখনই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রজতের উপর তার পৈশাচিক শক্তি নিয়ে।
মৃগাঙ্ক
ভট্টাচার্য এগিয়ে এলেন সাইড লাইনের ধারে। কাছে ডাকলেন অমিয়কে।
- কি করছো তুমি? না পারছো ওকে বশ করতে না পারছো ওই সাদা
বলটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে! হেরে গেলে কি হবে বুঝতে পারছো?
রাগে আর হতাশায়
চোখদুটো জ্বলে ওঠে অমিয়র।
- ওকে তো আমি
বশ করেছিলাম কিন্তু কি করে জানিনা ও আমার জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে। আপনি চিন্তা
করবেন না। এবার আমি অ্যাম্পায়ারকে বশ করবো।
চমকে ওঠেন
মৃগাঙ্কবাবু।
- মানে? অ্যাম্পায়ারকে বশ করে তুমি কি করবে?
আর অ্যাম্পায়ারকে বশ করতে গেলে রজতের উপর তোমার প্রভাব থাকবে না
কেননা তুমি এক সময়ে একজনকেই বশ করতে পারো।
শয়তানি হাসিতে
মুখটা ভরিয়ে তোলে অমিয়।
-
অ্যাম্পায়ারকে বশ করে আমি আমার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বল করবো। লাস্ট জাম্পে
যতটা পা বাড়িয়ে করা যায় ততটা বাড়িয়ে বল করবো আর আমার বলের লক্ষ্য থাকবে রজতের
মাথা। ঝড়ের গতিতে আসা ওই বল লাগলে রজতের ওখানেই সমাধি হবে আর অ্যাম্পায়ার আমার বশে
থাকার জন্য নো বল ও দেবে না।
অমিয়র ব্যাখ্যা
শুনে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের মুখেও। অমিয়র পিঠ চাপড়ে সরে গেলেন
তিনি। অমিয় ফিরে এল বোলিং মার্কে। তার আগেই অবশ্য দুইহাত ঘষে উৎপন্ন করেছে সেই
কালো সুতোর মতো ধোঁয়া যা ধীরে ধীরে গিয়ে অ্যাম্পায়ারের মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো।
অমিয় বিড়বিড় করে বলল- আমি এখন যে ডেলিভারি করবো তা অবশ্যই লিগাল ডেলিভারি। কোন নো বল নয়।
এদিকে যখনই
অমিয়র বশীকরণ কালো ধোঁয়া অ্যাম্পায়ারের মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো তখনই রজতের মধ্যেও
এলো একটা পরিবর্তন। ব্যাটসম্যান রাঘব
মিত্রের জায়গায় ফিরে এলো রজত রায়। রজত বুঝতে পারলো যে অমিয়র বশে সে আর নেই কিন্তু
তার সাথে এটাও মাথায় এলো যে ডানহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে সে এখন কিভাবে বাঁ হাতে অমিয়কে
সামলাবে!
ইতিমধ্যেই দৌড়
শুরু করেছে অমিয়। নিরুপায় রজত বাঁ হাতেই ব্যাট হাতে দাঁড়ালো। সে বুঝতে পারলো যে
চালের উপর চাল চেলেছে অমিয়। দৌড়ে আসা অমিয়র চোখে রক্তলোলুপ এক পিশাচের ছবি দেখতে
পেল রজত।
হঠাৎ যেন স্থির
হয়ে গেল চারপাশের সবকিছু। মাঠের বাইরে উৎসাহী দর্শকদের কোলাহল...মাঠের ভিতরে
বুলেটস ইলেভেনের খেলোয়াড়দের চিৎকার...সব যেন স্থবির হয়ে গেছে মুহুর্তের মধ্যে।
সমগ্র প্রকৃতি যেন নিথর। চলমান শুধু তার সামনে এগিয়ে আসা অমিয় যার হাত থেকে বেরোনো
ওই শুভ্র গোলক ধেয়ে আসছে রজতের দিকে তার প্রানশক্তি শুষে নেবার জন্য।
বোলিং ক্রিজের
অনেকখানি বাইরে পা ফেলে অমিয়। সরাসরি তার মাথা লক্ষ্য করে ছুটে আসা বলটা দেখে রজত
আন্দাজ করলো অমিয়র উদ্দেশ্য। চকিতে মাথা
নীচু করে ব্যাটটা বাড়িয়ে রেখেছিল সে। বল সেই ব্যাট ছুঁয়ে উইকেট কিপারের মাথার উপর
দিয়ে নিমেষে বাউন্ডারি পার করলো।
স্তব্ধ হয়ে থাকা
প্রকৃতি যেন প্রান ফিরে পেল। একদিকে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রজত দেখল যে সেখানে
তার রান দেখাচ্ছে ১৯ আর একদিকে দেখলো যে প্রবল উচ্ছ্বাসে মাঠের ভিতর ছুটে আসছে
ড্রিম ইলেভেনের খেলোয়াড়েরা।
ড্রিম ইলেভেনের
সতীর্থরা যখন রজতকে এসে জড়িয়ে ধরেছে তখনও রজতের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অমিয়র উপর নিবদ্ধ।
সতীর্থদের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে এগিয়ে এলো অমিয়র দিকে। হতাশ বিদ্ধস্ত অসহায় লাগছে
অমিয়কে। রজতের মনে পড়লো মাধববাবুর কথা।
"খেলার
মাঠে যদি তার পরাজয় ঘটে তবে তখুনি তার পিশাচশক্তি অন্তর্হিত হবে। কারন আমরা তাকে
দানুষ বানিয়েছিলাম খেলায় জেতার জন্য।"
রজতকে সামনে
দেখে মাথা নীচু হয়ে গেল অমিয়র। দুইহাত জড়ো করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে রজতের দিকে
তাকিয়ে শিশুর মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল সে। রজত অমিয়কে জড়িয়ে ধরে বলল- শান্ত হও
অমিয়। তোমার পরাজয়ে তোমার অশুভশক্তির
বিনাশ হয়েছে। তুমি আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছো। ব্যাস আর কি চাই...
অমিয়কে ছেড়ে
দিয়ে সবার থেকে একটু তফাতে সরে এলো রজত। প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে বার করে
আনলো একটা ছোট্ট ধারালো ছুরি। এরপর চোখ
বন্ধ করে নিজের হাতের তালুতে ছুরিটা চেপে ধরলো সে। সঙ্গে সঙ্গে ছুরির ধার তার হাতে
কেটে বসে গেল। টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো মাটিতে। একটু অপেক্ষা করলো রজত।
তারপরই রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরে ছুটলো সে ছোটদাদুর বাড়ির দিকে।
মেন গেট দিয়ে
ভিতরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো রজত। তার দৃষ্টি সামনের দিকে যেখানে একতলার বারান্দায়
হাতদুটো পিছনে করে পায়চারি করছেন রাঘব মিত্র।
আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রজতের চেহারা। তাহলে পেরেছে সে। ছোটদাদুকে বাঁচাতে,
তার সন্মান বাঁচাতে পেরেছে সে। তাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলেন রাঘববাবু। জড়িয়ে ধরলেন রজতকে। রজত সে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত
হয়ে বলল- কাল ফাইনালে দুইদলের এগারো এগারো বাইশজন খেলোয়ারই শুধু খেলবে ছোটদাদু।
কোন দানুষ কোন অলৌকিক শক্তি নয়, সাধারন মানুষ খেলবে
সত্যিকারের ক্রিকেট।
পরেরদিন
ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনালে ড্রিম ইলেভেন বুলেটস ইলেভেনকে ৫ উইকেটে হারিয়ে
চ্যাম্পিয়ান হলো। রজত বা অমিয় কেউই যদিও ফাইনালে খেলেনি। গতরাতের ঘটনার পর অমিয়
জ্বরে কাবু। ডাক্তার অবশ্য বলেছে যে বিশ্রাম দরকার অমিয়র। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে
যাবে।
রজত তার দাদু
রাঘব মিত্র ও মাধববাবুর সাথে বসে খেলা দেখেছে।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ ড্রিম ইলেভেনের সৌমেনকে পুরষ্কার রজতই প্রদান করে। পরেরদিন সকালে রজত কোলকাতায় ফিরে যাবার জন্য
প্রস্তুত। গাড়িতে ওঠার আগে রজত রাঘববাবু ও মাধববাবু দুজনকেই প্রনাম করে। রাঘববাবু
তাকে বলেন-
দাদুভাই
উপকারের কথা বলে তোমায় ছোট করবো না। শুধু এইটুকুই বলবো যে এবারে ইডেনে তোমার খেলা
থাকলে আমার জন্য একটা টিকিটের ব্যবস্থা করো। অনেকদিন কোলকাতায় যাই না কিন্তু যে
জীবনকে বাজি রেখে মাঠে নামে তার খেলা দেখতে তো যেতেই হবে।
---
0 মন্তব্যসমূহ