Ad Code

Responsive Advertisement

Ticker

6/recent/ticker-posts

বাক্স বন্দী--- কলমে- শিবাজী চ্যাটার্জী

 


বাক্স বন্দী

 

 কিরকির...কিরকির...কিরকির...আওয়াজটা ক্রমে ক্রমে অমরের কানে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। ঘুমে বোজা চোখটা অনেক কষ্টে খুলে সামনে তাকালো অমর। খুলে গেছে বাক্সটা। বাক্সের ডালাটা উপরে উঠে রয়েছে আর তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে মাথা বার করে বেরিয়ে আসছে মসৃন কালো চকচকে শরীরটা।  তার লেজের নড়াচড়ায় যে কিরকির কিরকির আওয়াজটা নির্দিষ্ট ছন্দে বেরিয়ে আসছে সেটা এই অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত। আফ্রিকার বিখ্যাত বা কুখ্যাত রাটেল স্নেক যে এখন নিজের পুরো শরীরটা বাক্সের ভিতর থেকে প্রায় বের করে সামনে থাকা শিকারকে এক ছোবলে ছবি করার জন্য ফনার বিস্তার করছে।

 

ট্রেনের কামরার নাইট ল্যাম্পের আলতো আলোয় মূর্তিমান বিভীষিকার ফোঁস ফোঁসানিতে অমর কিরকম জড়পদার্থের মতো বসে রইলো। আস্তে আস্তে সাপটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। হাত পা নাড়ানোর ক্ষমতাও বোধহয় অবলুপ্ত হয়েছে অমরের। চোখদুটো যেন কিরকম করছে... সাপের দেহটা ভাইব্রেট করতে করতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ওই...ওই মারলো ছোবল। তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এল অমরের গলা দিয়ে।

 

আর্ত চিৎকার দিয়ে ঘুমটা ভাঙল অমরের। উঠে বসে চারিধারে তাকালো হতভম্বের মতো।  হ্যাঁ,  ট্রেনেই আছে সে। চলেছে কায়রোর দিকে। কিন্তু রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে এখন সকালের আলো ফুটেছে।  ট্রেনের বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো কামরার ইতিউতি জায়গাকে আলোকিত করেছে।  অমর বুঝল যে একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন সে দেখেছে।  ওই তো সিল করা বাক্সটা রাখা আছে পাশের সিটে। খামোকাই সে...

উঠে জানলাটা খুলে দিল সে। আলোয় ভরে গেল গোটা কামরা।

 

বাক্সটা হাতে নিয়ে  আবার বসলো অমর। একটা ছোটখাটো অ্যাটাচীর আকারের সাইজ বাক্সটার। বাক্সের উপরে মিশরীয় দেবদেবীদের ছবি আঁকা রয়েছে আর হিয়রোগ্লিফিক ভাষায় লেখাও রয়েছে।  অমর যদিও এই ভাষাটি অল্পস্বল্প জানে তাও সে এটার পাঠোদ্ধার করতে পারেনি।

এই ভাষায় এক্সপার্ট হচ্ছে মেরিলিন কার্টার।  তার কাছেই যাচ্ছে অমর কায়রোতে।

ওহো...দেখেছেন এখনও অবধি অমরের পরিচয়টাই ভালো করে দেওয়া হলো না।  আসুন আমরা এবার একটু গল্পের কুশীলবদের সাথে পরিচিত হয়ে নি।

 

অমর উপাধ্যায় নৃতত্তবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর কলকাতা মিউজিয়ামে কর্মরত ছিল।  নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা এবং তারপর সেই অনুযায়ী চাকরি পেয়ে মোটামুটি খোশমেজাজেই কাটছিলো অমরের দিনগুলো।  নৃতত্তবিদ্যা নিয়ে পড়ার সময় থেকেই অমরের মিশরীয় সভ্যতার প্রতি আকর্ষন জন্মায়।  ক্রমে সেটা নেশায় পরিনত হয়।  জাদুঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থেকে শুধু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার জ্ঞান আহরণ করে সে।  মিশরদের ফারাও,  তাদের সমাধি,  অত্যাশ্চর্য ধনসম্পত্তি,  মমিফিকেশান,  পশুপাখিদের দেবদেবী জ্ঞানে পূজো করা,  মিশরীয় জাদু,  ব্ল্যাক ম্যাজিক...সবকিছু নিয়ে একেবারে ডুবে ছিল অমর।

 

এই সময়ই তার সাথে পরিচয় হয় জাদুঘরে বেড়াতে আসা প্রত্নতত্তবিদ জেমস কার্টারের সাথে।  অমরের মিশর সম্বন্ধে জ্ঞান ও অধ্যাবসায় কার্টারকে আকৃষ্ট করে।  নিজের পরবর্তী মিশর এক্সপিডিশনে যাবার জন্য অমরকে প্রস্তাব দেন তিনি। হাতে যেন চাঁদ পায় অমর।  মিশর...তার এতদিনকার পুঁথিলব্ধ জ্ঞানের ভান্ডারকে চাক্ষুষ দেখার আমন্ত্রণ!  এ যে তার স্বপ্নের অতীত। এক কথায় রাজী হয়ে যায় সে।  মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ছুটির বন্দোবস্ত করে ফেলে সে। তারপর বেরিয়ে পড়ে কার্টারের সাথে।  প্রথমে লন্ডনে আসে তারা। সেখানে কার্টার তার অভিযানের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করেন এবং লন্ডন থেকে তারা কায়রোর পথে যাত্রা করে। এই ধরনের অভিযান যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি খরচবহুল। কায়রোতে পৌঁছে তারা স্থানীয় কিছু অধিবাসীদের সাহায্য নেন। এদের মধ্যে অনেকেই কার্টারের পূর্ব পরিচিত এবং অতি বিশ্বস্ত।  এদের সাহায্য ছাড়া দুর্গম সাহারার বুকে এক্সপিডিশান চালানো একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার।

 

এরপর আরম্ভ হয় এক দুর্বার অভিযান। নিজের গবেষণা লব্ধ নথির উপর নির্ভর করে সাহারার দুর্গম অঞ্চলে জেমস কার্টার ১৮ দিনের খোঁজাখুজিঁ ও খননকার্যের পরে উদ্ধার করলেন ফারাও নেটোফেরিসের সমাধি। সমাধির অন্তঃস্থলে গিয়ে বেশ কিছু দুস্পাপ্য জিনিসের সাথে আবিষ্কার করা হয় পূর্বে উল্লিখিত বাক্সটির। বাক্সটি হাতে আসার পরেই অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন কার্টার। অমরকে সঙ্গে নিয়ে বাক্সটির উপরে খোদিত হিয়রোগ্লিফিক ভাষার পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেন কিন্তু খুব একটা সফল হন না। বাক্সটি খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারা। আসলে কার্টারের প্রায় প্রতিটি অভিযানে তার সাথে থাকে তার একমাত্র মেয়ে মিশর এক্সপার্ট মেরিলিন কার্টার। এবার মেরিলিন আসতে পারেনি ফলে সমস্যায় পড়েছে কার্টার। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কার্টার অমরকে বাক্সটি হস্তান্তর করে তার মেয়ের কাছে কায়রোতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন।

 

সেই বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অমর কায়রোর দিকে। ট্রেনে সফরকালে রাতে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে সে সেটা আমরা আগেই দেখেছি।  এই মুহুর্তে অমর বাক্সটি কোলে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের জানলার সামনে বসে। ভালো করে বাক্সটিকে লক্ষ্য করছে সে। কিভাবে যে এটি সিল করা সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে। বাক্সটার সামনে দুইদিকে কমলালেবুর কোয়ার সাইজের  দুটো সবুজ পাথরের চোখ।  অমর লক্ষ্য করল হঠাৎ যে যখনই সূর্যের আলো সরাসরি ওই অংশে পড়ছে তখনই সবুজ চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করে উঠছে।  সে বাক্সটাকে সরাসরি এবার আলোর দিকে ঘুরিয়ে দিল। এরপরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। সূর্যের আলো সামনের দিকে সরাসরি পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাক্সের ভিতর যেন একটা আলোড়ন শুরু হলো। ঘাবড়ে গিয়ে অমর বাক্সটা থেকে একটু তফাতে সরে এল। কটকট কটকট... একটা আওয়াজের সাথে এবার সত্যি সত্যি বাক্সটা খুলতে শুরু করল।

 

সবিস্ময়ে অমর দেখল যে বাক্সটা তারা অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি সেই মিশরীয় বাক্স সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে।  বাক্সটি পুরো খুলে যাবার পর অমর এগিয়ে এল বাক্সের কাছে।  অবাক হয়ে দেখল যে বাক্সের ভিতরটা জুড়ে রয়েছে একটা বই। কালো রঙের মলাটের ওই বইটা আস্তে করে বাক্স থেকে বের করে নিল অমর। ওজনে বেশ ভারী লাগল বইটা। ওপরে বড় বড় হিয়রোগ্লিফিক ভাষায় কিছু যেন লেখা।  নিজের মিশরলব্ধ জ্ঞান দিয়ে অমর পড়তে চেষ্টা করল।

 

হামুনাপ্ত্র...শিহরিত হল সে। হামুনাপ্ত্র! সাহারার বুকে লুকোনো সেই মৃতদের নগরী। যার কথা অনেকের মুখে শুনেছে সে। কেউ বলেছে কাল্পনিক আবার কেউ বিশ্বাস করে সেই নগরীর অস্তিত্ব।  তাহলে কি কার্টার ও অমর সেই মৃত নগরীর সন্ধান করে ফেলেছে?  নেটোফেরিসের সমাধির ভিতর পাওয়া এই বই তো সেটারই ঈঙ্গিত দিচ্ছে।  কিন্তু মিশরীয় প্রবাদ অনুযায়ী এই বই খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে পুরোহিত ইমহোটেপ এর সাথে সমাধিস্থ করা হয়েছিল যে ইমহোটেপকে ফারাও এর বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য দেওয়া হয়েছিল ভয়ংকর সাজা "হিউনডাই" অর্থাৎ জ্যান্ত মমি করা হয়েছিল তাকে এবং তার অনুচরদের।

 

 কথিত আছে যে ভয়ংকর অভিশাপ জড়িয়ে আছে এই বইয়ের সাথে।  অপেক্ষা করে আছে ইমহোটেপ ও তার সঙ্গীদের অতৃপ্ত আত্মারা।  হামুনাপ্ত্র বা বুক অফ ডেডের মাধ্যমে যদি তারা একবার ফিরে আসে তো প্রলয় আসবে পৃথিবীতে।  আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা কিছু অত্যুতসাহী মানুষ নাকি এই বইয়ের উপাচার করেছিল। ফিরে এসেছিল ইমহোটেপ তার ক্রোধ ও অতৃপ্ত ভালবাসা নিয়ে।  বহু নিরীহ মানুষের প্রানের বিনিময়ে আবার ফেরত পাঠানো গেছে তাকে নরকে। মিশরীয় কালো জাদুর এক জ্বলন্ত উদাহরন এই বই।

 

বইটা হাতে নিয়ে এতক্ষণ এইসব কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল অমরের মাথায়।  আচ্ছা,  কার্টার কি অনুমান করেছে এই বাক্সের ভিতর কি আছে!  তাই কি তড়িঘড়ি অমরকে দিয়ে বাক্সটা পাঠিয়ে দিল মেয়ের কাছে।  ঠিক আছে,  নিজের কর্তব্য নিশ্চয়ই পালন করবে অমর। কিন্তু বইটা একটু পড়ার লোভ সে সামলাতে পারছে না?

 

আস্তে করে অতি সাবধানে বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা খুলল অমর। প্যাপাইরাসে লেখা হিয়রোগ্লিফিকের ভাষার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল সে।

দমকা একটা হাওয়া উঠল হঠাৎ।  উপরে তোলা ট্রেনের জানলার কপাটা দড়াম করে নেমে এসে চমকে দিল অমরকে। আবার জানালাটা খোলার চেষ্টা করল সে। কিন্তু খোলা যাচ্ছে না কিছুতেই।  বোধহয় জ্যাম হয়ে গেছে।  এদিকে কামরা অন্ধকার হয়ে গেছে।  উঠে গিয়ে কামরার লাইটের সুইচ অন করলো সে। কিন্তু লাইটও জ্বলল না। বিরক্তিতে অমর এবার নিজের কামরার বন্ধ দরজার হাতল ধরে টান দিয়ে অবাক হলো। দরজাটাও খুলছে না। এটাও জ্যাম হলো নাকি! অগত্যা অন্ধকারে হাতড়ে নিজের ব্যাগ থেকে মোমবাতি বার করে জ্বালালো সে। মোমবাতির স্বল্প কম্পমান আলোয় কামরার অন্ধকার কিছুটা দূরীভুত হলো। সেই মোমবাতি নিয়ে অমর এসে বসল বইটার সামনে।  একটা অদম্য কৌতুহল তাকে যেন টেনে এনে বসালো বইটার সামনে।  পড়তে শুরু করলে সে...

 

"হে পরমপিতা... শক্তি দাও আমায়। সঞ্চার করো, একত্রিত করো শক্তির আঁধার। অপার্থিব ক্ষমতায় বলশালী করো আমায়। নিমেষে হোক জাগরণ অন্ধকার জগতের। আসছি আমি...সংকেত দাও প্রলয়ের।"

 

আবার একটা দমকা হাওয়ার সাথে নিভে গেল মোম বাতি। চমকালো অমর। জানলা দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও কোথা থেকে হাওয়া এল! বন্ধ ট্রেনের কামরায় বসে অমর ধারনাও করতে পারলো না যে বাইরের আবহাওয়াটা এরিমধ্যে বদলে গেছে।  কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। বিদ্যুত চমকের সাথে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা যেন কোন এক আসন্ন প্রলয়ের ঈঙ্গিত দিচ্ছে। দেশলাই দিয়ে আবার মোমবাতি জ্বালালো সে আর সাথে সাথেই দারুন আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। এক বিকট বিভৎস চেহারা...সারা শরীরে মাংস বলে কিছু নেই।  রক্তের শিরা উপশিরা দিয়ে যেন শরীরটা তৈরি।  চোখের জায়গায় দুটো মনি যেন প্রচন্ড শক্তির অধিকারী হয়ে অমরের দিকে বিদ্রুপ বর্ষন করছে।  আধখাওয়া মুখের বা শরীরের  ভিতর থেকে স্ক্যারাব পোকার আনাগোনা।  সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল অমর ভয়ে ও আতঙ্কে কিন্তু তার চেয়ে ওই ভয়ংকর চেহারা মরন উল্লাসে আরও তিনগুন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে এক ফুঁয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল। ট্রেনের ইঞ্জিনের জোরালো আওয়াজ ও বৃষ্টির প্রোকোপে চাপা পড়ে গেল অমরের মরন আর্তনাদ।

 

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই মেজাজটা বিগড়ে রয়েছে মেরিলিন কার্টারের। এক তো ঘুম ভেঙেছে বেশ বেলায়। তার উপর ঘুম ভাঙতেই যদি দেখা যায় যে প্রকৃতির মুখ ভার তাহলে কার মেজাজ ভালো থাকে! এমনিতেই মেরিলিন ঠিক করেছিল যে আজ সকাল সকাল সে বেরিয়ে পড়বে। বাবার এক্সপিডিশানের জায়গায় যাবে  সে। ব্যাগ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়িও বুক করে রেখেছিল সে। কিন্তু একটু আগেই ড্রাইভার ফোন করে জানিয়েছে যে এই মারাত্মক দুর্যোগে সে গাড়ি নিয়ে সাহারায় যাবে না। সত্যি কি ভীষন ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে গোটা কায়রো জুড়ে।  কালো হয়ে আছে গোটা আকাশ। ঘন ঘন মেঘবর্ষন আর প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার সাথে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।  বাইরে দুহাত দূরের বস্তু দৃষ্টি গোচর হচ্ছে না।

একরাশ বিরক্তি আর মনখারাপ নিয়ে হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল মেরিলিন। বৃষ্টির ছাঁটে তার রাত্রিবাস অল্পঅল্প ভিজে যাচ্ছে।  চোখে মুখে লাগছে বৃষ্টির ছিটে। হাত দিয়ে মুখের জল মুছে সামনে তাকাল মেরিলিন।  আসলে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল বাবার ওখান থেকে কোন খবর নেই।  তাই একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে তার। এই ধরনের অভিযানে পদে পদে বিপদের ঝুঁকি থাকে। মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে মেরিলিন ও অনেক পড়াশোনা করেছে।  এই বিষয়ে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ ও বলা যেতে পারে।

 

যত মিশরীয় ইতিহাস পড়েছে মেরিলিন ততই মিশরীয় জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিক... এই ধরনের বিষয়ে গাঢ় বিশ্বাস জন্মেছে তার। আর তাই বাবার এই মিশর ঘুরে পুরোনো সমাধিস্থল আবিষ্কার ও সেগুলোয় খোঁড়াখুঁড়ি সে পুরোপুরি মন থেকে মানতে পারে না। অজানা একটা ভয় তার মনকে তখন ঘিরে ধরে।  অনেক অভিশাপ জড়িয়ে থাকে এদের ঘিরে।  তা থেকে যদি তার বাবার কোন বিপদ হয়! কি করবে সে! কেউ তো আর নেই তার এই বিশাল পৃথিবীতে।  তার এই ২১ বছরের জীবনে বাবাই তো সব। তারমধ্যে এবার আবার ইন্ডিয়া থেকে এক বাঙালিকে সঙ্গী করে জুটিয়ে এনেছে।  ছোকরাকে এমনিতে খারাপ লাগেনি মেরিলিনের কিন্তু বাবার মতোই মনে হয় ইতিহাস পাগল বা বলা ভাল মিশর পাগল। নইলে তার মতো একজন সুন্দরী মহিলাকে সামনে পেয়েও সারাক্ষণ সমাধি,  মমি, লিপি এইসব বকবক করে গেছে অভিযানে যাবার সময়।

 

হঠাৎ রুমের ফোনটা বেজে উঠতে চিন্তায় ছেদ পড়ল তার। দৌড়ে রুমে এসে রিসিভার তুলল মেরিলিন।  তবে কি বাবার কোন খবর এল? 

অনুমান মিথ্যা নয় মেরিলিনের। হোটেলের রিসেপশন থেকে জানাল যে অমর উপাধ্যায় বলে একজন এসছেন এবং তিনি মেরিলিনের সাথে দেখা করতে চাইছেন। অমরকে তার রুমে পাঠিয়ে দেবার কথা বলে মেরিলিন চট করে তার স্বচ্ছ রাত্রিবাসের উপর একটা গাউন চাপিয়ে নিল। অমর এসেছে মানে নিশ্চয়ই কোন খবর নিয়েই এসেছে। কিন্তু কোন খারাপ খবর নয়তো! মনটা আবার আশংকায় দুলে উঠল মেরিলিনের।

রুমের দরজায় নক হতেই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলল মেরিলিন।  সামনে

দাঁড়ানো অমরকে দেখে স্বস্তি ও আশংকা দুটোরই ছবি ফুটে উঠল তার মুখে।  বাইরের দুর্যোগের ছবি নিয়ে আপাদমস্তক ভিজে অমর ভিতরে ঢুকে বলল- চিন্তার কিছু নেই।  স্যার ভাল আছেন। কয়েকটি জরুরি জিনিস কায়রো থেকে নিয়ে যাবার জন্য আমায় আসতে হয়েছে।  

হালকা হেসে মেরিলিন বলল- ওকে ম্যান। তোমরা ভাল আছো শুনে ভাল লাগল। বাট বাবা কোন চিঠি দেয়নি আমায়?

মেরিলিনের চোখের দিকে তাকিয়ে অমর বলল- না। আমাকেই তো চিঠি করে পাঠিয়ে দিলেন। বলো কি জানতে চাও?

তারপর এগিয়ে এলো মেরিলিনের দিকে।

- তোমায় খুব সুন্দর লাগছে মেরি। একদম ফ্রেস লাগছে।  

একটু অবাক হয়ে মেরিলিন বলল- বাব্বা! মিশরের উপর থেকে নজর সরে নজর পড়েছে তাহলে আমার উপর।

অমর এবারে মেরিলিনের মুখের উপর হাত বুলিয়ে বলে উঠল- আন-উখ-সোনা-মুন।

আবার হাসে মেরিলিন।  অমরের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে- এবার যাও। বাথরুমে গিয়ে ড্রেসটা চেঞ্জ করে নাও।  পুরো ভিজে আছো।

 

অমর সুটকেস খুলে ড্রেস নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপরেই সহসা চেঞ্জ হয়ে গেল মেরিলিনের মুখ। ওইরকম বরফের মতো ঠান্ডা কেন অমরের হাত? তার বাবা তার মেয়ের জন্য কোন চিঠি পাঠাবেন না এটাও মেরি মানতে পারছে না। আরও অদ্ভুত লাগছে যে অমরের শরীর থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে। একরকম রাসায়নিক গন্ধ এবং তার সাথে অনেকদিন কোন বদ্ধ জায়গায় কেউ আটকে থাকলে যে ভ্যাপসা গন্ধ থাকে এবং পচা মাংসের গন্ধ তার সাথে মিশে মেরির নাকে পৌঁছেছে।  তাছাড়া বাথরুমে ঢোকার আগে কি কথা বলে গেল অমর!

 

 আন-উখ-সোনা-মুন! হঠাৎ অভিশপ্ত পুরোহিত ইমহোটেপের অভিশপ্ত প্রেমিকা আন-উখ-সোনা-মুন এর নাম অমরের মুখে কেন?

অমরের ছেড়ে যাওয়া জামা কাপড়ে হাত লাগালো মেরি। তার কোটের ভিতরের পকেটে খুঁজে পেল কাঙ্খিত জিনিসটা...কার্টারের চিঠি।

 

"প্রিয় মেরি,

আজ আমার এতদিনকার সাধনা মনে হয় সার্থক হয়েছে।  নেটোফেরিসের সমাধিতে একটা অদ্ভুত বাক্স পেয়েছি।  অনেক টানাহ্যাঁচড়া করেও খুলতে পারিনি। উপরে অনেক লেখার মধ্যে শুধু "হামুনাপ্ত্র" কথাটা উদ্ধার করতে পেরেছি।  আমার মনে হয় ভিতরে সেই বুক অফ ডেড ই রয়েছে।  তাই অমরকে দিয়ে বাক্সটা তোমার কাছে পাঠালাম। যদি বাক্সটা খুলতে পারো আর ওই বইটি পাও তাহলে সোজা লন্ডন চলে যাবে এবং আমাদের ব্যাংকের লকারে ওটা রেখে দেবে। মনে রেখো খুব বিপদজনক জিনিস ওটা। যদিও অমর যথেষ্ট সাবধানী এবং বিশ্বস্ত ছেলে, ওকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই কিন্তু যদি ওটা বই হয়, তোমায় বারংবার বলছি ভুলেও যেন ওটা পড়ার দুঃসাহস করো না।

ইতি,

    জেমস কার্টার

 

স্তব্ধ হয়ে গেল মেরি চিঠিটা পড়ে।  কই, অমর এসে তো বলল না, উল্টে অস্বীকার করল যে মেরির বাবা তাকে কোন চিঠি দেয়নি। কিন্তু কেন! তাছাড়া অমরের সাথে চিঠিতে উল্লেখিত বাক্সের কোন চিন্হ তো মেরি দেখতে পেল না।

বুক অফ ডেডের কথা মেরিও শুনেছে।  সত্যি কি মিথ্যা তা মেরি জানে না কিন্তু মিশরীয় প্রবাদ অনুযায়ী এটা জানে যে ওই বইয়ের অপব্যবহার  হলে ভয়ানক দূর্বিপাক নেমে আসবে।  অমর কি কোনক্রমে ওই বাক্স খুলেছে বা ওই বইয়ের কথা জেনে গিয়ে গোপন করছে! 

তার এই ভাবনার মাঝেই বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হলো মেরির পিছন দিকে।  সঙ্গে সঙ্গে মেরি চিঠিটা দলা পাকিয়ে নিজের বুকের ভিতর ঢুকিয়ে নিল।

 

একরাশ হাসি নিয়ে অমরের দিকে ঘুরলো মেরি।  তার তীব্র কটাক্ষ বানে অমরের মনে প্রেমের তরঙ্গ উছলিয়ে উঠল।

- ওঃ অমর, আই মাস্ট সে, ইউ হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ফিজিক। আমি আগে তোমায় খালি গায়ে দেখিনি বাট এখন দেখে... 

- এখন দেখে কি মনে হচ্ছে মেরি?

মেরির দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো অমর।

- মনে হচ্ছে তোমার অপেক্ষাতেই আমি এতদিন ছিলাম অমর।

 

অমর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে মেরিকে। মেরির মুখটা তুলে ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে। দুজনে দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। অমরের গরম নিশ্বাস অনুভব করতে পারে মেরি।  তার মনে হতে থাকে অমর যেন শুধু তার ঠোঁট থেকে নয়, পুরো শরীর থেকে সমস্ত রস শুষে নিতে চাইছে।  একটু জোর করেই সে ঠেলে সরিয়ে দিল অমরকে। রীতিমতো হাঁপাতে শুরু করেছে মেরি। অমর কিন্তু দিব্যি স্বাভাবিক।  মেরি দেখল যে চূড়ান্ত আবেগপূর্ণ দৃষ্টিতে অমর তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল- আন-উখ-সোনা-মুন।

মেরি দেখল যে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অমরের মুখটা এক লহমায় বিকৃত হয়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে মানুষের শরীর অন্তর্হিত হয়ে হাড় মাংস মজ্জাহীন শুধু অক্ষিকোটর বিশিষ্ট ভয়ংকর কদাকার চেহারা নিল অমর উপাধ্যায়। আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল মেরিলিন কার্টার। সেই ভয়ংকর চেহারা মেরির একদম কাছে এসে বিকৃত আওয়াজে বলে উঠল- 

নরকের দ্বার থেকে ফিরে এসেছি আমি তোমার জন্য।  তোমার হাত ধরেই আমার মুক্তি।

এসো মেরিলিন... আমার কাছে এসো।

সভয়ে পিছিয়ে গেল মেরি। চিৎকার করে বলে উঠল- কে তুমি? কেন এসেছো? কোথায় বুক অফ ডেড?অমর কোথায়? 

শিরা উপশিরার সেই শরীর অট্টহাস্য করে উঠল। মুখটা আরও ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠছে।  স্ক্যারাব পোকা মুখের একদিক ফালাফালা করে দিয়ে অন্যদিকে আশ্রয় নিল।

- হামুনাপ্ত্র...  আমার কাছে। তুমি চলো আমার সাথে পাতালে। ক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে তোমার আমার মিলন সম্পূর্ণ হবে আন-উখ-সোনা-মুন।

 

আবার চিৎকার করে উঠল মেরি- না, কখনোই না। তোমাকে আবার আমি ফেরত পাঠাবো নরকে শয়তান।

প্রবল অট্টহাসির সাথে সেই প্রেত মেরিলিনের হাত ধরল আর তার সাথে সাথেই একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে হোটেল রুম থেকে দুজনেই অদৃশ্য হল।

 

জ্ঞান যখন ফিরলো মেরিলিনের তখন নিজেকে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করলো সে। একটা বড়ো ঘরে একটা বড়ো থামের সাথে বাঁধা রয়েছে সে।

আস্তে আস্তে মেরির কানে আসতে লাগলো চারিপাশের আওয়াজ। একটা প্রার্থনা সঙ্গীত যেন চলছে তার আশেপাশে।  আধো অন্ধকার আধো আলোয় ভরা ঘরে চোখটা সইয়ে নিয়ে চারিদিকে তাকাল মেরিলিন। মেরির চারপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে কালো আলখাল্লা পরা একদল লোক। কারোর মুখই অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে তারা কিরকম একটা দুর্বোধ্য ভাষায় প্রার্থনা করছে। বোঝার চেষ্টা করলো মেরিলিন কিন্তু বুঝতে পারলো না। তারপর হঠাৎই গমগম করে উঠল একটা গলার আাওয়াজ।

 

"হে আমার মহান ভগবান। তুমি ভালো আর তুমি খারাপ...আলো তুমি অন্ধকার তুমি...ফিরিয়ে দাও আমার আন-উখ-সোনা-মুন কে...গ্রহন করো বলি আমার।"

অমররূপী সেই ভয়ংকর প্রেত এর গলা থেকে নির্গত কথাগুলো শুনে শিউরে উঠল মেরিলিন। সভয়ে দেখল যে সেই বুক অফ ডেড অমররেই হাতে রয়েছে। মেরিলিনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অমর তার হাতে থাকা বুক অফ ডেডের পাতা ওল্টালো। এইসময় মেরির কানে এল তার বাবার গলার আওয়াজ।

- খবরদার বিশ্বাসঘাতক, রেখে দাও ওই বই। ওর একটা শব্দ উচ্চারন করলে তোমার সর্বনাশ হবে।

ক্রুদ্ধ চোখে অমর কার্টারকে দেখল এবং তারপর বইয়ের একটি বিশেষ পৃষ্ঠা উল্টে উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান করলো শয়তানের দূতদের।

 

"আব ইউ খুস্কা...ইব সিউ ডাই"

"আব ইউ খুস্কা...ইব সিউ ডাই"

- হে মৃত্যু প্রেতের দল...এসো, ধ্বংস করো শত্রুদের।

বন্ধ ঘরের চারিদিকে যেন একটা আলোড়ন উঠল। অমরের দেহের থেকে একটা নীলচে আলোর স্রোত বেরিয়ে এল আর সেই স্রোত কঠিন আকার নিয়ে জন্ম নিল চার মূর্তিমান প্রেত। মিশরীয় মমির আদল নেওয়া সেই প্রেতের শিরা উপশিরা রক্তমাখা চেহারা দেখে আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল মেরি ও কার্টার।

 

অমরের আদেশে সেই প্রেতের দল হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কার্টার ও তার অন্য সঙ্গীদের উপর। নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল কার্টারের লোকদের।  কার্টারের দুইপা দুইজন প্রেত দুইদিক দিয়ে ধরে টেনে দুইটুকরো করে দিল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল নরমাংস ও রক্তের ফোয়ারা। বাবার অবস্থা দেখে পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল মেরি আর তার চিৎকারকে ছাপিয়ে উঠল অমরের অট্টহাসি। বইটা দুইহাতে নিয়ে অমর এগিয়ে আসে মেরির কাছে।  

- তোমায় তো এবার তোমার বাবার কাছে যেতে হবে মেরিলিন। তাহলেই আসবে আন-উখ-সোনা-মুন আমার কাছে আর আমিও হবো অমর।

তীব্র ঘৃনায় অমরের দিকে তাকিয়ে মেরি বলল- তোমাকেই আমি নরকে পাঠাবো শয়তান। যে ভুল অমর করে ফেলেছে তার প্রায়শ্চিত্ত আমি করব।

আবার মেরির একদম কাছে চলে এল অমর। বিকট ঘড়ঘড় স্বরে বলে উঠল - আন-উখ-সোনা-মুন।  

স্ক্যারাবের কামড়ে একদিক ক্ষয়ে যাওয়া মুখমন্ডল মেরিলিনের মুখের সামনে। পচা দেহের দুর্গন্ধে মেরির প্রায় বমি আসবার উপক্রম তবুও সে ওই ভয়ংকর চেহারার অমরের দিকে প্রেমের ঈঙ্গিতে তাকানোর চেষ্টা করল। মনে মনে মেরিলিনের একটাই পরিকল্পনা আর সেটা হলো যে করে হোক প্রেতরূপী অমরের কাছ থেকে ওই বইটা দখল করা।

মেরির দৃষ্টিতে এমন একটা ঈঙ্গিত ছিল যেটা অমরের হৃদয়ে আঘাত করল। তারপর যখন মেরিলিন অমরের ওই ভয়ংকর চেহারা অগ্রাহ্য করে তার গলা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আবেগমিশ্রিত স্বরে বলে ওঠে - ইমহোটেপ... আমার ইমহোটেপ...

 

যুগ যুগ ধরে ভালবাসার কাঙাল ইমহোটেপ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়। দুইহাত দিয়ে  আঁকড়ে ধরে মেরিলিনকে। হাত থেকে স্খলিত হয়ে পড়ে যায় বই। গভীর আবেশের চুম্বনে ডুবে যায় দুটি ঠোঁট।  তারপরই অমরকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় মেরি। হতবাক অমর দ্যাখে যে ইতিমধ্যে বুক অফ ডেড নিজের হাতে তুলে নিয়েছে মেরিলিন।  খুলে ফেলেছে তার নির্দিষ্ট পাতা। দৃঢ় প্রত্যয়ে উচ্চারন করলো নির্দিষ্ট শব্দ।

"কাদিসমায় কাদিসমায়...প্যারাডুস প্যারাডুস"।

 

এক লহমায় মুখের চেহারা বদলে গেল অমরের।  দারুন আতঙ্ক আর হতাশা এসে গ্রাস করলো তাকে।  তখনই ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। চূর্ন হয়ে গেল ঘরের একদিকের দেওয়ালের কিছুটা অংশ। তীরের মতো নীল আলোর রশ্নি প্রবেশ করলো ঘরে এবং বিদির্ন করলো অমরের বুক। বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল অমরের গলা দিয়ে।  গোটা শরীরটা বেঁকেচুরে যেন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইল। ওই বিকৃত অবয়ব একটা পুঞ্জীভূত কালো ধোঁয়ার স্তূপে পরিনিত হলো এবং ঘরের ওই ফাঁকা অংশ দিয়ে নিমেষে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই অমরের অচৈতন্য দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।  মেরিলিনের কানে বাতাসের মর্মরধ্বনির মতো ভেসে এল একটা দীর্ঘশ্বাস...আন-উখ-সোনা-মুন।

দৌড়ে এল মেরি অমরের কাছে। তুলে ধরল তার মাথাটা পরম যত্নে। শ্বাস এখনও চলছে তার। মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল মেরি। তার দুচোখ দিয়ে তখন অঝোরে জলের ধারা নামছে।

পেরেছে সে...পেরেছে অমরকে রক্ষা করতে...পেরেছে বুক অফ ডেডকে অশুভ শক্তির থেকে দূরে রাখতে।  ইমহোটেপের অতৃপ্ত ভালবাসা এবারও হয়তো পূর্নতা পেল না কিন্তু মেরিলিন কার্টার হয়তো এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও তার ভালবাসার বীজ খুঁজে পেল। অবশ্যই সে হারিয়েছে তার বাবাকে... বুক অফ ডেড বা হামুনাপ্ত্র কে জাগালে তার মূল্য তো শোধ করতপই হবে কালের অমোঘ নিয়মে।

২৫ বছর পরে...

কোলকাতা...

 

উপাধ্যায় পরিবারের সবচেয়ে বর্নময় চরিত্র অমর উপাধ্যায়ের লন্ডনে ৫২ বছর বয়সে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর কয়েকদিন আগেই এসে পৌঁছেছে কোলকাতার বাড়িতে। আজ দুপুরবেলা তার স্ত্রী মেরিলিন কার্টার এসে পৌঁছায় কোলকাতার বাড়িতে। অমরের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী এবার বাকি জীবনটা কোলকাতাতেই থাকবে সে। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা তাকে রিসিভ করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলে এই মুহুর্তে বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য অমরের ভাগনে কলেজপড়ুয়া নিখিলেশ তার মেরিলিন মামীর জিনিসপত্র এক এক করে ভিতরে ঢোকাচ্ছে।  তখনই প্যাকিং ঢিলা হয়ে একটি প্যাকিং বাক্স থেকে মাটিতে পড়ল একটা ক্যাসকেড বা বাক্স। কালো রং এর বাক্সটা নিখিলেশের কৌতুহল উদ্রেক করলো। বাক্সটা তুলে ধরে সে বুঝতে চেষ্টা করলো কিভাবে খোলা যায় কিন্ত অনেক টানাটানিতেও খুলল না। বাড়ির বাইরের বারান্দায় এসে বসলো নিখিলেশ। এবার বাক্সটাকে সামনে রেখে দেখতে লাগল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে বাক্সটার গায়ে। হঠাৎ নিখিলেশ দেখল যে বাক্সের সামনে দুদিকে থাকা দুটো সবুজ রঙের চোখ আপনা থেকেই মাঝখানে চলে এল আর একটা খটাস শব্দের সাথে বাক্সটার ডালা খুলতে শুরু করল...

-----


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ